কোন সার কি কাজ করে | সার প্রয়োগ পদ্ধতি

জমিতে জৈব সার বেশি ব্যবহারের ফলে জমিতে কোনো ক্ষতি হয় না। কিন্তু রাসায়নিক সার বেশি ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরা শক্তি এবং ফসল নষ্ট হয়ে যায়। জানুন রাসায়নিক সারের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে।

জৈব ও অজৈব সারের পার্থক্য

সার একটি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক উপাদান যা জমির উর্বরা শক্তিকে বৃদ্ধিকরার মাধ্যমে ফসল উৎপাদনকে বৃদ্ধি করে। তা ছাড়া গাছকে সুস্থসবল ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সার বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তবে সার প্রধানত দুই প্রকার। যেমন- জৈব সার, রাসায়নিক সার। জৈব সার সাধারণত জৈবিক উপায়ে তৈরি কার হয়। একে আবার প্রাকৃতিক সারও বলে। অন্য দিকে রাসায়নিক উপাদান দিয়ে তৈরি হয় রাসায়নিক সার। আজকের আলোচনায় থাকবে রাসায়নিক সারের ব্যকহার, কাজ, অভাব জনিত লক্ষণ, ব্যবহারের ফলাফল ও প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে-

১। ইউরিয়া সারের কাজ

ইউরিয়া একটি রাসায়নিক সার এর রাসায়নিক উপাদান হলো নাইট্রোজেন।ফসলের জমিতে এর ব্যবহার ব্যাপক। ইউরিয়া সারে নাইট্রোজেন থাকে ৪৬%। শিকড়ের বৃদ্ধি বিস্তাররে সহায়তা করে নাইট্রোজেন সার। সাধারণত গাছের ও শাকসবজির পর্যাপ্ত পরিমাণে ডালপালা, পাতা, কান্ড বৃদ্ধিতে নাইট্রোজেন সার সাহায্য করে। এছাড়া নাইট্রোজেন সার গাছের পাতার ক্লোরোফিল বৃদ্ধির মাধ্যমে পাতাকে আরো সবুজ রাখে এবং কুশি বৃদ্ধি ও ফলন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

ইউরিয়া বা নাইট্রোজেনের অভাব জনিত লক্ষণ

ইউরিয়া বা নাইট্রোজেনের অভাব হলে মাটির পুষ্টি উপাদানের ঘাটতির বা অভাব দেখা এবং ক্লোরোফিল সংশ্লেষণের হার অনেকাংশে কমে যায়। যার কারণে গাছের সবুজ রং হারিয়ে যায়। এছাড়া পাতার আকার ছোট হয়ে যায়। পাতার অগ্রভাগ থেকে বিবর্ণতা শুরু হয় এবং বৃন্ত ও শাখা প্রশাখা সরু হয়ে যায়। পুরাতন পাতার মধ্যশিরার র্শীষভাগ হলুদ হয়ে যায়।

ইউরিয়া বেশি মাত্রা ব্যবহারের ফলাফল

অতিরিক্ত মাত্রায় ইউরিয়া ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরা শক্তি কমে যায়। গাছে ফুল ও ফলের উৎপাদন কমে যায়। তাছাড়া পোকা মাকড়ের আক্রমন বেড়ে যায়। আবার অনেক সময় পাতার অংশ ভারি হয়ে যায়।

ইউরিয়া সার প্রয়োগ পদ্ধতি

ধান চাষের সময ইউরিয়া ০৩ অংশে ভাগ করে প্রয়োগ করতে হবে এবং শাকসবজি চাষের সময় ফসলের বৃদ্ধির পর্যায়ের সঙ্গে সমন্বয় করে ইউরিয়া ২-৩ ভাগে ভাগ করে প্রয়োগ করা উচিত।

২। টিএসপি, ডিএপি বা ফসফেট জাতীয় সারের কাজ

টিএসপি মানে ট্রিপল সুপার ফসফেট ও ডিএপি মানে ডাই এ্যামোনিয়াম ফসফেট। এই দুটোই হলো ফসফেট জাতীয রাসায়নিক সার। টিএসপি ও ডিএপি এই সার দুটোতে আছে ২০ ভাগ ফসফরাস এবং টিএসপিতে  শতকরা ১৩ ভাগ ক্যালসিয়াম এবং ১.৩ ভাগ গন্ধক রয়েছে। এছাড়া ডিএপিতে ফসফেট ছাড়াও ১৮% নাইট্রোজেন উপস্থিত থাকার কারণে ডিএপি সার প্রয়োগ করলে বিঘা প্রতি ৫ কেজি ইউরিয়া সার কম দিতে হয়।

ফসফরাস সার কোষ বিভাজনে অংশগ্রহণ করে।গাছের মূল বা শিকড় গঠন ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এছাড়া ফসফরাস সার গাছের কাঠামো শক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে এবং নেতিয়ে পড়া রোধ করে। ফলের পরিপক্কতা ত্বরান্বিত্ব করে। এর বিশেষ উপকার হচ্ছে ফসফরাস ফুল,ফল ও বীজের গুণগত মান বৃদ্ধি করে।

ফসফরাসের অভাব জনিত লক্ষণ

যদি গাছের ও মূলের বৃদ্ধি না হয় তাহলে বুঝতে পারবেন আপনার জমিতে ফসফরাসের ঘাটতি হয়েছে। ফসফরাসের কারণে গাছের শাখা প্রশাখা কুন্ডলাকৃতি বা পাকানো হয়ে যায়। গাছের পুরাতন পাতা অসময়ে ঝরে পড়ে। পাতার গোড়া রক্তবর্ণ বা ব্রোনজ রং ধারণ করে থাকে এবং পাতার পৃষ্ঠভাগ নীলাভ সবুজ বর্ণ ধারণ করে। এছাড়া গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।

ফসফরাস প্রয়োগের মাত্রা বেশি হলে

যদি ফসফরাসের মাত্রা জমিতে বেশি হয়ে যায় তাহলে জমিতে ফলন কমে যায়। তা ছাড়া গাছের বৃদ্ধি কমে যায়।

ফসফেট সার প্রয়োগ পদ্ধতি

ফসফেট প্রয়োগ করার উত্তম সময় হলো জমি তৈরির সময় শেষ চাষের ২/১ দিন আগে।

৩। এমওপি সার বা পটাশ সারের কাজ

এমওপি মানে মিউরেট অব পটাশ। এর শতকরা ৫০ ভাগ পটাশিয়াম। এমওপি সার গাছের কোষের ভেদ্যতা রক্ষা করে এবং উদ্ভিদে শর্করা বা শ্বেতসার দ্রব্য পরিবহনে সহায়তা করে। এর সাথে  লৌহ ও ম্যাংগানিজের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে।পটাশ সার গাছের প্রোটিন বা আমিষের উৎপাদনে সহায়তা করে। তাছাড়া গাছের কাঠামো শক্ত করে এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এর একটি বিশেষ উপকারিতা হলো নাইট্রোজেন ও ফসফরাস পরিশোষণে সমতা বজায় রাখে।

আরো জানুন-আবারো বাড়লো সারের দাম | সারের মূল্য তালিকা ২০২৩

এমওপি বা পটাশ সারের অভাব জনিত লক্ষণ

পটাশ সারের ঘাটতি হলে বুঝবেন পুরাতন পাতার কিনারা থেকে বিবর্ণতা শুরু হয়। পরে পাতার আন্তঃশিরায় বাদামি বর্ণের টিস্যু দেখা যায়। এছাড়াও পাতার উপরিভাগে কুঞ্চিত হতে বা ভাঁজ পড়তে থাকে। গাছ বিকৃত আকার ধারণ করে এবং গাছের ছোট আন্তঃপর্বসহ বৃদ্ধি কমে যায়।

পটাশ সারের পরিমাণ বেশি হলে

জমিতে অতিরিক্ত পটাশ সারের পরিমাণ বেশি হলে ক্যালসিয়াম ও বোরনের শোষণ হার কমে যায়। এর ফলে বোরনের অভাবজনিত লক্ষণ দেখা যায়। এছাড়া পানি নিঃসরণের হার কমে যায় ও গাছের বৃদ্ধি অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পায়।

পটাশ সার প্রয়োগ পদ্ধতি

পটাশ ও গন্ধক জাতীয় সারগুলো জমি তৈরির শেষ চাষে একবারে প্রয়োগ করলে হয়। তাছাড়া মোটা বুনটযুক্ত মাটিতে পটাশ সার দুইভাগে ভাগ করে ব্যবহার করতে পারেন। প্রথম ভাগ হলো জমি তৈরির শেষ সময় এবং দ্বিতীয় ভাগ হলো দ্রুত কুশি বের হওয়ার সময।

৪। জিপসাম সারের কাজ

জিপসাম সারে আছে শতকরা ১৭ ভাগ গন্ধক ও ২৩ ভাগ ক্যালসিয়াম। জিপসাম তেল উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। রয়েছে। তাছাড়া জিপসাম বা গন্ধক প্রোটিন বা আমিষ উৎপাদনে সহায়তা করে। গন্ধক ক্লোরোফিল গঠনে ভূমিকা রাখে ও গাছের বর্ণ সবুজ রাখে। জিপসাম বীজ উৎপাদন ও হরমোনের কার্যকারিতা বাড়াতে সহায়তা করে।

জিপসামের অভাব জনিত লক্ষণ

জিপসামের অভাব হলে গাছের পাতার সবুজ অংশ নষ্ট হয়ে যায় এবং কান্ড চিকন হয়ে যায়। এছাড়া গাছের পাতা ফ্যাকাশে হয়ে যায়।

জিপসামের প্রয়োগ মাত্রা বেশি হলে

জিপসামের প্রয়োগ মাত্রা বেশি হলে গাছের শিকড় চিকন হয়ে যায় এবং গাছের সবুজ অংশ নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া শিকড় বৃদ্ধি কমে যায়।

৫। জিংক সালফেট সারের কাজ

জিংক সালফেট সারে সালফেট ( মনোহাইড্রেটে ) আছে শতকরা ৩৬.০ ভাগ দস্তা এবং ১৭.৬ ভাগ গন্ধক আছে। অন্যদিকে জিংক সালফেট ( হেপটাহাইড্রেটে ) দস্তা ও গন্ধক আছে যথাক্রমে  ২১.০ % এবং ১০.৫% । তাছাড়া চিলেটেড জিংকে আছে ১০ % দস্তা। জিংক সালফেট (হেপটাহাইড্রেট)  তুলনায় জিংক সালফেট (মোনোহাইড্রেট) বেশি পরিমাণে মাটিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কোনো কোনো ফসলে এই সার  স্প্রে করে প্রয়োগ করা যায়। গাছে বিভিন্ন ধরনের হরমোন তৈরিতে, ক্লোরোফিল, ফসলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে দস্তা বা জিংক অংশগ্রহণ করে থাকে।

জিংকের অভাব জনিত লক্ষণ

মাটিতে জিংকের ঘাটতি দেখা গেলে গাছের পাতায় তামাটে  অথবা দাগ আকারে বিবর্ণতা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। তাছাড়া পাতা আকার ছোট হয়ে যায় ও নতুন পাতার গোড়ার দিক থেকে বিবর্ণতা দেখা যায়।

আরো জানতে পারেন- ধানের ছড়া মরা রোগের প্রতিকার

জিংকের মাত্রা বেশি হলে

অতিরিক্ত দস্তা প্রয়োগে আমিষ উৎপাদন হয় না। এছাড়া জমিতে জিংকের পরিমাণ বেশি হলে গাছে বিষক্রিয়া তৈরি হয়।

জিংক সার প্রয়োগ পদ্ধতি

দস্তা বা জিংক সারও শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে।

৬। বোরণ সারের কাজে

বোরন সারে বা বরিক এসিড ১৭ % এবং সলুবোর বোরণে ২০%  বোরণ থাকে। বোরণ সার গাছের কোষ বৃদ্ধিতে এবং  পাতা ও ফুলের রং আকর্ষণীয় করতে সাহায্য করে। তাছাড়া বোরণ সার পরাগরেণু সুস্থ ও সবল রাখতে সহায়তা করে। বোরণ সার  বীজ উৎপাদনে সাহায্য করে এবং চিটা হওয়া রোধ করে। বোরন সার  গাছে ফুল ও ফল ধারণে সাহায্য করে এবং ফলের বিকৃতি রোধ করতে সহায়তা করে।

বোরণ সারের অভাব জনিত লক্ষণ

জমিতে বোরন সারের অভাবে গাছের বৃদ্ধি কমে যায় ও গাছে ফুল সংখ্যায় কম আসে। তাছাড়া বোরণ সারের ঘাটতি হলে গাছের অগ্রভাগ মরে যায় এবং কাণ্ড কালো বর্ণ ধারণ করে। গাছের শিকড়ের বৃদ্ধি কমে যায় এবং সবজি বা ফল গাছের ফুল ঝরা বেড়ে যায়। তাছাড়া বোরণ সার কম হলে ফলের আকারে ছোট হয় এবং ফেটে যায়।

বোরণ সারের মাত্রা বেশি হলে

জমিতে বোরণের প্রয়োগ মাত্রা বেশি হলে কচি পাতা ও ডগা নষ্ট হয়ে ফলন অনেক কমে যায়।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *