মরিচের পাতা কোকড়ানো রোগের সহজ সমাধান
মরিচের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার মূল কারণ হলো মরিচের পাতা কোঁকড়ানো রোগ। এই রোগ বিভিন্ন মাধ্যমে হয়। তাই চলুন মরিচের পাতা কেঁকড়ানো রোগ সম্পর্কে জেনে আসি।
মূলত পোকা-মাকড়ের আক্রমণের কারণে মরিচের পাতা কোঁকড়ানো রোগে হয়ে থাকে। সাধারণত কয়েক ধরণের মাকড়ের আক্রমণে মরিচ গাছে মরিচের পাতা কোঁকড়ানো রোগ হয়। যেমনঃ থ্রিপস পোকা, লাল মাকড়, এফিড বা জাব পোকা এবং সাদা মাছি।
এছাড়াও মরিচ গাছ মাটি থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন এবং পুষ্টি না পেলে মাটি থেকে পুষ্টি যোগাতে শিকড়ের অক্ষমতার কারণে অতিরিক্ত জল খেয়ে ফলে, যার কারণে মরিচের পাতা কোকড়ানো রোগ হয়। তাই আসুন জেনে আসি মরিচের পাতা কোঁকড়ানো রোগের কারন, লক্ষণ ও সহজ সমাধান বা প্রতিকার সম্পর্কে।
থ্রিপস পোকার আক্রমণে মরিচের পাতা কোকড়ানো রোগ হয়
এই থ্রিপস পোকার আক্রমণে মরিচের পাতা কুঁকড়ে যায়। এই থ্রিপস পোকা মরিচ গাছের কচি পাতা ও ডগার রস শুষে খেয়ে ফলে। যার কারণে মরিচের পাতা উপরের দিকে কুঁকড়ে যায় এবং মরিচ গাছ দূর্বল হয়ে যায়।
থ্রিপস পোকার আক্রমণে মরিচের পাতা কোঁকড়ানোর লক্ষণ
- মরিচ গাছের পাতার মধ্যশিরার আশেপাশে বাদামী রঙ হয়ে যায় ও পাতা শুকিয়ে যায়।
- পাতার নিচের পিঠে অনেক ক্ষতি হওয়ার কারণে পাতা নৌকার খোলের মতো করে পাতা উপরের দিকে কুঁকড়ে যায়।
- পোকায় আক্রান্ত পাতা দেখতে খুবই বিকৃত দেখায়।
আরো জানুন – মরিচের সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা
থ্রিপস পোকা দমন ব্যবস্থাপনা
- যদি মরিচ গাছে কুঁকড়ানো পাতার পরিমাণ কম হয় তাহলে সেগুলো ছিঁড়ে ফেলতে হবে এবং ক্ষেত পরিষ্কার করে রাখতে হবে।
- আক্রান্ত মরিচ গাছে এবং গাছের পাতায় ভালো করে পরিষ্কার পানি স্প্রে করতে হবে।
- প্রাকৃতিকভাবে ফসল সুরক্ষায় ব্যবহৃত হলুদ স্টিক ট্র্যাপ ব্যবহার করে পোকা দমন করা যেতে পারে।
- পোকানাশক হিসেবে ১ কেজি আধা ভাঙ্গা নিম বীজ নিয়ে ২০ লিটার পানিতে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে সেই পানি ছেঁকে নিয়ে পাতার উপরের দিকে স্প্রে করতে হবে।
- যদি থ্রিপস পোকার আক্রমণ বেশি হয় বা পাতা বেশি কুঁকড়ে যায় তাহলে ফিপ্রোনিল (রিজেন্ট/এসেন্ড/গুলি/অন্য নামের) বা ডাইমেথয়েট (বিস্টারথোয়েট/টাফগর/অন্য নামে) ১০ লিটার পানিতে ১০ মিলি হারে বা সাকসেস ১০ লিটার পানিতে ১২ মিলি হারে ভালো করে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
- যদি থিপ্রস পোকা বেশি দেখা দেয় এডমেয়ার ২০ এসএল ০.৫ মিলি হারে ১ লিটার পানিতে শিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
- এই থিপ্রস পোকার আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য মরিচ গাছের চারা রোপনের ৩০ দিনের মধ্যে তিন বার করে অর্থাৎ ১০ দিন পর পর প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৫মিলি এ্যাডমায়ার/টিডো/গেইন ঔষধ মিশিয়ে প্রতি ৫ শতক জমিতে স্প্রে করতে হবে।
আরোও পড়ুন – ধানের শীষ মরা রোগে করণীয় | ধানের ছড়া মরা রোগের প্রতিকার
লাল মাকড়ের আক্রমণে মরিচের পাতা কোকড়ানো রোগ হয়
এই লাল মাকড় পোকার আক্রমণে মরিচের পাতা কুঁকড়ে যায়। এই লাল মাকড় মরিচের পাতার রস চুষে খায়। এই লাল মাকড়ের আক্রমণে মরিচের ফলন পূর্বের তুলনায় প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ হ্রাস পায়।
লাল মাকড়ের আক্রমণে মরিচের পাতা কোঁকড়ানোর লক্ষণ
- এই লাল মাকড়ের আক্রমণে মরিচের আক্রান্ত পাতার নিচের দিকে উলটানো নৌকার মতো হয়ে যায়।
- এই লাল মাকড়ের আক্রমণে মরিচের পাতা কুঁকড়ে এবং শুকিয়ে যায়।
- এই লাল মাকড়ের আক্রমণে মরিচের পাতা ও ফুলের কলি ঝড়ে পরে যায়।
- এই লাল মাকড়ের আক্রমণে মরিচ ফলের আকৃতি ছোট হয়ে যায় এবং মরিচ গাছের ফলের ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পায়।
আরোও পড়ুন – মরিচ চাষ পদ্ধতি
লাল মাকড় দমন ব্যবস্থা
- লাল মাকড় দমণে সালফার জাতীয় কীটনাশক ১ লিটার পানিতে ৫ গ্রাম মিশিয়ে সকালে বা বিকালে সূর্য ডোবার পর স্প্রে করতে হবে এবং এবাবে ১০ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে। অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ।
- মরিচের উৎপাদন বৃদ্ধিতে পাইরিথ্রয়েড জাতীয় কীটনাশক ব্যবহার করা যাবে না।
- এই লাল মাকড়ের আক্রমণ বেশি হলে মাকড়নাশক ওমাইট ৫৭ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি অথবা ভার্টিমেক ১.৮ ইসি প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১২ মিলি পরিমাণে মিশিয়ে মরিচের পাতা ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।
- যদি লাল মাকড়ের সাথে অন্য পোকার আক্রমণ দেখা যায় তাহলে প্রথমে মাকড়নাশক ব্যবহার করে তারপরে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
- মরিচ গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রতি ১৫ দিন পর পর প্রতি লিটার পানিতে দুই গ্রাম রিডোমিল গোল্ড মিশিয়ে বিকেলের শেষ দিকে প্রয়োগ করতে হবে।
আরোও জানতে পারেন – শসা চাষ পদ্ধতি ও রোগ বালাই দমন ব্যবস্থাপনা
এফিড বা জাব পোকার আক্রমণে মরিচের পাতা কোকড়ানো রোগ হয়
মরিচ গাছের পাতা কচি অথবা বয়স্ক অবস্থায় থাকা কালীন এই এফিড বা জাব পোকার আক্রমণ করে থাকে।
এফিড বা জাব পোকার আক্রমণে মরিচের পাতা কোঁকড়ানোর লক্ষণ
- এই এফিড পোকা মরিচের পাতার নীচের দিকে বসে পাতার সব রস শুষে খায় ফলে মরিচ গাছের পাতা কুঁকড়ে যায়।
- এই এফিড বা জাব পোকা মরিচের গাছের কান্ডেও আক্রমণ করে। যার ফলে মরিচের কান্ড শুকিয়ে মরিচ গাছ মারা যায়।
আরোও জানুন – ইঁদুর মারার কেীশল
এফিড বা জাব পোকা দমন ব্যবস্থা
- প্রতি হেক্টর জমিতে ৪০ টি আঠালো হলুদ স্টিক ট্র্যাপ ব্যবহার করতে হবে।
- ৫০ গ্রাম আধা ভাঙ্গা নিম বীজের নির্যাস ১লিটার পানিতে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে মিশ্রণ তৈরী করে মিশ্রণটি ছেঁকে নিয়ে আক্রান্ত মরিচ গাছে ১০ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
- এফিড বা জাব পোকার আক্রমণ বেশি হলে স্বল্পমেয়াদী বিষক্রিয়ার ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি অথবা কুইনালফস ২৫ ইসি বা ডাইমেথয়েট বা কেরাতে ১০ লিটার পানিতে ১০ মিলি পরিমাণে বা সাকসেস ১০ লিটার পানিতে ১২ মিলি পরিমাণে ভালোমতো মিশিয়ে মরিচ গাছে স্প্রে করতে হবে।
আরোও জানুন – জানুন এলোভেরা চাষ পদ্ধতি, সার ব্যবহার ও রোগবালাই নিয়ে
সাদা মাছির আক্রমণে মরিচের পাতা কোকড়ানো রোগ হয়
এই সাদা মাছি কচি চারা গাছকে আক্রমণ করে থাকে। এই সাদা মাছি মরিচের পাতার নিচে বসে রস শুষে খায়। যার ফলে মরিচের পাতা কুঁকড়ে যায়। এছাড়াও এই সাদা মাছি হলুদ মোজাইক ভাইরাস বহন করে।
সাদা মাছির আক্রমণে মরিচের পাতা কোঁকড়ানোর লক্ষণ
সাদা মাছির আক্রান্ত গাছের পাতা কুঁকড়ে যায় এবং স্বাভাবিক পাতার তুলনায় মরিচের পাতা পুরু হয়ে যায়।
- মরিচের পাতাগুলো ছোট গুচ্ছাকৃতির হয়ে যায়।
- মরিচ গাছের বৃদ্ধি কমতে শুরু করে।
- মরিচ গাছের পর্বগুলো কাছাকাছি হয়ে যায় এবং মরিচ গাছ খর্বাকৃতি হয়ে পড়ে।
- মরিচ গাছে অতিরিক্ত ডালপালা জন্মাতে শুরু করে এবং গাছে ঝোপের মতো সৃষ্টি হয়।
- মরিচের ধারণক্ষমতা কমে যায় এবং মরিচ ফল আকারে ছোট ও কুঁকড়ানো সৃষ্টি হয়।
সাদা মাছি দমন ব্যবস্থা
- সাদা মাছি আক্রমণের আগেই সুস্থ গাছ থেকে পরবর্তী মৌসুমের জন্য বীজ সংগ্রহ করে রাখতে হবে।
- রোগাক্রান্ত চারা কোনো অবস্থাতেই রোপন করা যাবে না।
- মরিচ গাছ চারা অবস্থায় বীজ তলা মশারির নেট দ্বারা ঢেকে রাখতে হবে।
- রোগাক্রান্ত মরিচ গাছ এবং আশপাশের উদ্ভিদ তুলে ধ্বংস করতে হবে।
- সাবান-পানি ব্যবহার বা প্রতি ১ লিটার পানিতে ২ গ্রাম ডিটারজেন্ট স্প্রে করতে হবে।
- সাদামাছি নাশক হিসেবে ৫০ গ্রাম আধা ভাঙ্গা নিম বীজের নির্যাস ১ লিটার পানিতে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে মিশ্রণ তৈরী করে মিশ্রণটি ছেঁকে নিয়ে স্প্রে করতে হবে।
- সাদা মাছির আক্রমণ বেশি হলে ম্যালাথিয়ন ৫৭ইসি প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১০ মিলি পরিমাণ মিশিয়ে অথবা এডমায়ার ২০০ এসএল প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৫ মিলি পরিমাণ মিশিয়ে মরিচ গাছে স্প্রে করতে হবে।
- এছাড়াও রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
- ডাইনোটোফুরণ ২০ % এস. জি ১ গ্রাম পরিমাণ নিয়ে ২.৫ লিটার পানিতে মিমিয়ে স্প্রে করতে হবে।
আরোও পড়ুন –মাল্টা চাষ পদ্ধতি, মাল্টার রোগ ও প্রতিকার
এছাড়াও মরিচ গাছ সবসময় ভালো রাখতে মরিচ গাছ চারা অবস্থা থেকে ম্যালাথিয়ন জাতীয় কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি পরিমাণ মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য ও পরামর্শ, ফসলের চাষ পদ্ধতি, সার প্রয়োগ এবং ফসলের বিভিন্ন রোগ বালাই সম্পর্কে জানতে নিয়মিত ভিজিট করূন Krishakbd.com
FAQs
মরিচ গাছে মরিচের কান্ড পঁচা রোগ, পাতা কোঁকড়ানো রোগ, মোজাইয়েক রোগ এবং মরিচের মোড়ক ভাইরাস রোগ সহ বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে।
মরিচের পাতা কুঁকড়ে যাওয়ার কারণ হলো মরিচ গাছ মাটি থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন এবং পুষ্টি না পেলে মাটি থেকে পুষ্টি যোগাতে শিকড়ের অক্ষমতার কারণে অতিরিক্ত জল খেয়ে ফলে, যার কারণে মরিচের পাতা কোকড়ানো রোগ হয়।
মরিচ গাছের ফুল ঝরে যাওয়ার কারণ হলো দিনের তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাতের তাপমাত্রা ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর অতিরিক্ত হওয়া এবং অতিবৃষ্টি হওয়া, মরিচ গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকা ও মরিচের ফুল এর পরাগায়ন হতে না পারা। এছাড়াও লাল সারের অভাবে মরিচের গাছের ফুল ঝড়ে যায়।
মরিচের জন্য সবচেয়ে ভালো ছত্রাকনাশক হলো রিডোমিল গোল্ড ছত্রাকনাশক।
ক্লোরফিলের অভাবে মরিচ গাছের পাতা হলুদ হয়
মরিচের ফলন বৃদ্ধির উপায় হলো মরিচ গাছে PGR/GP3/নাইট্রোবেনজিন/জিনেলিপ এসিড ব্যবহার করা। এছাড়াও মরিচের ফলন বৃদ্ধির জন্য মরিচ সারিবদ্ধভাবে রোপণ করতে হবে যাতে আগাছা নিড়ানি ও খোঁপা করা সহজে তোলা যায়।
বোম্বাই মরিচ গাছে ফুল ঝড়ে যাওয়ার কারণ হলো দুর্বল পরাগায়ন হওয়া, পরিবেশগত চাপ সৃষ্টি হওয়া,, গাছে পুষ্টির ঘাটতি থাকা, কীটপতঙ্গ এবং রোগের আক্রমণ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।
মরিচ গাছে সার দেওয়ার নিয়ম হলো মরিচের চারা লাগানোর ২০ থেকে ২৫ দিন আগে গোরবসার মাটির সাথে মিশিয়ে নিয়ে জমিতে প্রতি হেক্টরে গোবর ১০ টন, ইউরিয়া ২৫০ কেজি, টিএসপি ২০০ কেজি এবং এমওপি সার ১৫০ কেজি প্রয়োগ করে মচি গাছ রোপন করতে হবে।