রজনীগন্ধা ফুল চাষ পদ্ধতি, বীজ রোপন ও পরিচর্যা
আমাদের দেশে বর্তমানে রজনীগন্ধা ফুলের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। কারণ, সব অনুষ্ঠানে এই ফুলের প্রয়োজন পড়ে। তাই চলুন জেনে নিই অর্কিড ফুলের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে।
রজনীগন্ধা ফুলের ইংরেজী নাম হলো Rosemary flower এবং এই রজনীগন্ধা ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম হলো Polianthes tuberosa. এ ফুলের জন্মস্থান মেক্সিকোতে। এই রজনীগন্ধা ফুল প্রতি রাতেই সুগন্ধ ছড়ায় এবং পরিবেশকে বিমোহিত করে। এছাড়াও কাটফ্লাওয়ার হিসেবে ফুলদানীতে সাজানোর জন্য এই রজনীগন্ধা ফুল অনন্য।
প্রতিদিনই বাংলাদেশে এ ফুলের উত্তরোত্তর চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে এই ফুলের যথেষ্ট চাষাবাদ হচ্ছে। তাই চলুন রজনীগন্ধা ফুলের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানি।
আরোও পড়তে পারেন – অর্কিড ফুল চাষ পদ্ধতি
রজনীগন্ধা ফুলের জাত
রজনীগন্ধা ফুলের আকার ও পাঁপড়ির উপর ভিত্তি করে এই ফুলকে ৩ শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। সেগুলো হলোঃ
- সিংগেল রজনীগন্ধা ফুলঃ এই সিংগেল রজনীগন্ধা ফুলের পাঁপড়ি একটি সারিতে থাকে। এই সিংগেল রজনীগন্ধা ফুল এর রং সম্পূর্ন সাদা এবং এই ফুলগুলো খুবই সুগন্ধযুক্ত হয়ে থাকে।
- সেমি-ডাবল রজনীগন্ধা ফুলঃ এই সেমি-ডাবল রজনীগন্ধা ফুলের পাঁপড়ি দুই অথবা তিন সারিতে সাজানো থাকে এবং এই ফুলও খুবই সুগন্ধ ছড়ায়।
- ডাবল রজনীগন্ধা ফুলঃ এই ডাবল রজনীগন্ধা ফুলে তিনটির অধিক পাপঁড়ির সারি থাকে। আর এই ডাবল রজনীগন্ধা ফুলের পাঁপড়িগুলোর কিনারায় হালকা লাল রং এর আভা থাকে এবং এই ফুল কম সুগন্ধযুক্ত হয়।
তবে বাংলাদেশে সিংগেল ও ডাবল রজনীগন্ধা ফুল পাওয়া যায়।
আরোও পড়ুন – টবে সূর্যমুখী ফুল চাষ পদ্ধতি
রজনীগন্ধা ফুলের বীজ সংগ্রহ
রজনীগন্ধা ফুল এর চাষ বীজ ও কন্দ উভয়ের মাধ্যমেই করা যায়। কারণ, এই রজনীগন্ধা ফুল এর বীজ কা কন্দ থেকেই বংসবিস্তার করে। তবে আমাদের দেশে সাধারণত রজনীগন্দা ফুলের কন্দ (গাছের গোড়ার ঝাড়/বাল্ব) এর দ্বারাই রজনীগন্ধার চাষ করা হয়ে থাকে। তাই নার্সরী থেকে শীতের শেষে এই রজনীগন্ধা ফুলের কন্দ সংগ্রহ করে চাষ করলে এই ফুলের ভালো ফলন পাওয়া যায়।
আরোও জানতে পারেন – ফুল চাষ পদ্ধতি | টবে ফুল চাষ পদ্ধতি
রজনীগন্ধা ফুল চাষের জলবায়ু ও মাটি নির্বাচন
রজনীগন্ধা ফুলের উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া খুবই উপযোগী। তাই গ্রীষ্ম কালে এই রজনীগন্ধা ফুলের চাষ করা উত্তম এবং দোআঁশ মাটি রজনীগন্ধা ফুল চাষের জন্য খুবই উত্তম।
রজনীগন্ধা ফুল চাষের পূর্বে নির্ধারিত জমিটিতে লাঙ্গল বা নিড়ানি দিয়ে ৪ থেকে ৫ বার চাষ দিয়ে জমির মাটি ঝুরঝুরে করে জমিটি ভালভাবে তৈরী করে নিতে হবে।
রজনীগন্ধা ফুল চাষের জমিতে সার প্রয়োগ
রজনীগন্ধা ফুল চাষের জমি তৈরী করার সময় শেষ বারের চাষের ক্ষেত্রে হেক্টর প্রতি জমির উর্বরতা ভেদে জমিতে বিভিন্ন সার প্রয়োগ করে জমিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
সারের নাম | পরিমাণ (হেক্টর প্রতি) |
---|---|
গোবর সার | ৫ -১০ টন |
এমওপি সার | ২০০ কেজি |
ফসফেট সার | ২৫০ কেজি |
এরপর রজনীগন্ধা ফুলের কন্দ বা বাল্ব রোপনের ৩ সপ্তাহ পর গাছের বৃদ্ধি শুরু হওয়ার সাথে সাথে হেক্টর প্রতি ১৫০ কেজি ইউরিয়া সার জমিরে উপরিভাগে বা গাছে প্রয়োগ। এরপর আরো ১৫০ কেজি ইউরিয়া সার গাছে পুষ্পদন্ড বের হওয়ার সময় উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
এছাড়াও ভালো মানের রজনীগন্ধা ফুল পাওয়ারর জন্য হেক্টর প্রতি ১২ কেজি বরিক এসিড এবং ৮ কেজি জিঙ্ক সালফেট প্রয়োগ করতে পারেন।
আরও পড়তে পারেন – গাঁদা ফুলের চাষ পদ্ধতি
রজনীগন্ধা ফুলের কন্দ বা বীজ রোপন পদ্ধতি
- প্রথমে রজনীগন্ধা ফুলের বালো কন্দগুলো বাছাই করতে হবে।
- তারপর বাঁছাইকৃত রজনীগন্ধা ফুলের বাল্বগুলো মার্চ খেকে এপ্রিল মাসে জমিতে রোপন করতে হবে।
- রজনীগন্ধা ফুলের কন্দ লাগানোর সময় গাছের পুরানো শিকড়গুলো কেটে দিতে হবে।
- রজনীগন্ধা ফুলের ভালো পাওয়ার জন্য এই ফুলের কন্দ এমনভাবে রোপন করতে হবে যেন লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব হয় ৩০ সে: মি: এবং প্রতি লাইনে কন্দ থেকে কন্দের দূরত্ব হবে ২০ সে: মি:।
- রজনীগন্ধার কন্দগুলো জমিতে এমনভাবে রোপন করতে হবে যেন এই ফুলের অগ্রভাগ ঠিক মাটির নিচে সমতলে অবস্থান করে।
- জমিতে রজনীগন্ধার প্রতিটি বাল্ব সোজা করে ৭-১০ সে:মি: মাটির গভীরে রোপন করতে হবে।
- মাটিতে রসের অভাব থাকলে রজনীগন্ধার কন্দ জমিতে লাগানোর পূর্বে সেচ প্রদান করা উচিত। এছাড়াও রজনীগন্ধার কন্দ রোপণের পর মাটিতে কন্দ বসার জন্য হালকা সেচ দিতে হবে মাঝে মাঝে।
আরও পড়তে পারেন – গোলাপ ফুল চাষ পদ্ধতি
রজনীগন্ধা ফুল চাষের অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা
- সবসময় রজনীগন্ধা ফুলের বাগান আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
- শুকনো মৌসুমে ফুলের বাগানে প্রয়োজন মত সেচ দিতে হবে। কিন্তু গাছের গোড়ায় পানি জমতে দেওয়া যাবে না।
- বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি সুনিস্কাশনের জন্য রজনীগন্ধার ফুলের বাগানে নিস্কাশন নালা তৈরি করতে হবে।
- রজনীগন্ধা গাছের গোড়া থেকে পওড় থাকা শুকনো বা মরা পাতাগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে।
- শীতকালে রজনীগন্ধা গাছের ভালো ফলনের জন্য এর উপরের অংশ সম্পূর্ন ভাবে কেটে দিলে ভালো হবে।
আরও পড়তে পারেন – বেলিফুল চাষ পদ্ধতি
রজনীগন্ধা ফুল চাষে রোগ-বালাই দমন ব্যবস্থাপনা
রজনীগন্ধা ফুলের পোকা দামন
সাধারণত রজনীগন্ধা ফুলের গাছে এফিড ও থ্রিপস পোকা আক্রমণ করে। তাই এসব পোকা দমনের জন্য ২মিলি পরিমাণ ম্যালাথিয়ন প্রতি লিটার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে ৭ থেকে ১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।
রজনীগন্ধা ফুলের বোট্রাইটিস পাতায় দাগ ও ব্লাইট রোগ নিরাময়
সাধারণত এই রজনীগন্ধা ফুলের বোট্রাইটিস পাতায় দাগ ও ব্লাইট রোগটি বর্ষা ঋতুতে দেখা যায়। আর এই রোগের আক্রমণে প্রথমে রজনীগন্ধা ফুলে গাড় বাদামী রং এর দাগ পড়ে এবং গাছের সমস্ত পাতা ও পুস্পমঞ্জরি শুকিয়ে যায়। আর এই রোগ নিরাময়ে রোভরাল বা ম্যানকোজেব ২% হারে পানিতে মিশিয়ে ৭ থেকে ১০ দিন অন্তর অন্তর স্প্রে করতে হবে।
রজনীগন্ধা ফুল কাটা বা তোলার নিয়ম
রজনীগন্ধার বাগান থেকে পরপর ৩ বছর রজনীগন্ধা ফুল উৎপাদন বা পাওয়া যায়। রজনীগন্ধা ফুল একটি লম্বা ডাটার মাথায় মঞ্জরী আকারে হয়। তাই রজনীগন্ধার পুষ্পদন্ডের প্রথম ফুল ফুটলেই ডাঁটিসহ এই ফুল কাটতে হয়। এই রজনীগন্ধা ফুল ভোরের ঠান্ডা আবহাওয়ায় অথবা পড়ন্ত বিকেলে কাটতে বা উত্তোলন করতে হয়।
আর রজনীগন্ধা ফুল কাটতে হয় ধারালো ছুরি দিয়ে মাটি থেকে ৪ থেকে ৬ সেমি উপরে ফুলের ডাঁটি সহ। প্রতি হেক্টরে প্রায় ১ লক্ষ রজনীগন্ধা ফুলের কন্দ রোপন করে ৩.৫ লক্ষ ফুলের ডাঁটি বা ফলন পাওয়া যায়।
রজনীগন্ধা ফুল প্রক্রিয়াজাতকরণ বা বাজারজাতকরণ
প্রস্বেদনের কারণে রজনীগন্ধা ফুলের জলীয় ক্ষতি এড়ানোর জন্য যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি এর অপ্রয়োজনীয় পাতাগুলো অপসারণ করে সুবিধামত ফুলের বান্ডিল তৈরি করে একটি বালতিতে চিনি সহ পানিতে ২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে দিতে হবে। এরপরে ছিদ্র যুক্ত একটি পলিথিনে ফুলগুলো জড়িয়ে বাজারজাত করতে হবে।
আর এই প্রক্রিয়ায় রজনীগন্ধা ফুলের জীবনকাল দীর্ঘ হয়। প্রতি হেক্টরে প্রায় ১ লক্ষ রজনীগন্ধা ফুলের কন্দ রোপন করে ৩.৫ লক্ষ ফুলের ডাঁটি বা ফলন পাওয়া যায়।
আশা করি রজনীগন্ধা ফুলের চাষ পদ্ধতি নিয়ে পোস্টটি আপনার কাজে লাগবে। এছাড়া, কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য ও পরামর্শ, ফসলের চাষ পদ্ধতি, সার প্রয়োগ এবং ফসলের বিভিন্ন রোগ বালাই সম্পর্কে জানতে নিয়মিত ভিজিট করূন Krishakbd.com
FAQs
বর্তমানে স্থানীয় বাজারে রজনীগন্ধা ফুলের প্রতিটি ডাঁটির দাম বা খুচরা মূল্য ২ থেকে ৪ টাকা। তবে ঋতু বিশেষে এবং সময়বেদে এই রজনীগন্ধা ফুলের মূল্য বেশ পরিবর্তনশীল।
প্রায় সারা বছরই রজনীগন্ধা ফুল ফোটে তবে শীতকালে এই রজনীগন্ধা ফুল কম ফোটে।