মাসকলাই চাষ পদ্ধতি
মাসকলাই একটি শক্ত ও খরা- সহিষ্ণু ফসল এবং খেতে খুবই সুস্বাদু। এখন আমরা মাসকলাই-এর চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানবো।
বাংলাদেশে চাষকৃত ডাল ফসলের মধ্যে মাসকলাইয়ের স্থান চতুর্থ। দেশে মোট উৎপাদিত ডালের ৯-১১% আসে মাসকলাই থেকে।
মাসকলাই একটি শক্ত ও খরা- সহিষ্ণু ফসল যা উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। ডাল ফসল হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এখন আমরা মাসকলাই-এর চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানবো।
জাত সমূহ
বাংলাদেশে চাষকৃত মাসকলাইয়ের বেশ কিছু উন্নত ও স্থানীয় জাত রয়েছে।
- উফশী জাত
- পান্থ
- শরৎ
- হেমন্ত
- বিনা মাস-১
- বিনা মাস-২
- স্থানীয় জাত
- রাজশাহী
- সাধুহাটি
মাসকলাই চাষ পদ্ধতি
মাসকলাই চাষে জমি নির্বাচন
সুনিষ্কাশিত দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি মাসকলাই চাষের জন্য উপযোগী। উঁচু থেকে নিচু সব ধরনের জমিতে মাসকলাই চাষ করা যায় যদি পানি জমে থাকার আশঙ্কা না থাকে। মাসকলাই উষ্ণ ও শুকনো জলবায়ুর ফসল।
মাসকলাই চাষে জমি তৈরি
মাসকলাই চাষের জন্য খুব মিহিভাবে জমি তৈরির প্রয়োজন হয় না। জমি ও মাটির প্রকারভেদে ২-৩ টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে জমি সমান করে তৈরি করতে হয়।
মাসকলাই বীজ বপনের সময়
মাসকলাই বীজ ফেব্রুয়ারীর শেষ থেকে মধ্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বপন করা যায়।
মাসকলাই বীজ বপন পদ্ধতি
মাসকলাইয়ের বীজ ছিটিয়ে বা সারি করে বপন করা যায়। তবে বীজের জন্য সারিতে বপন করা ভালো। সারিতে বপন কতার ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরুত্ব ৩০ সেঃমিঃ রাখতে হয়।
সারিতে বীজগুলো অবিরতভাবে ২-৩ সেঃমিঃ গভীরে বীজ বপন করা হয়। ছিটানো পদ্ধতিতে শেষ চাষের সময় মই দিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হয়।
মাসকলাই বীজ শোধন
বীজ বাহিত রোগ দমনের জন্য বীজ শোধন করে বপন করা দরকার।
মাসকলাই চাষে সার ব্যবস্থাপনা
সারের নাম | সারের পরিমান (হেক্টর প্রতি) |
ইউরিয়া | ১৬০-১৮০ গ্রাম |
টিএসপি | ৩৪০-৩৮০ গ্রাম |
এমওপি | ১২০-১৬০ গ্রাম |
অনুবীজ সার | ১৬-২০ গ্রাম |
মাসকলাই চাষে সার প্রয়োগের নিয়মাবলি
জমি তৈরির শেষ চাষের সময় সব সার প্রয়োগ করতে হবে। জীবানু সার প্রয়োগ করা হলে ইউরিয়া সার প্রয়োগের দরকার হয় না।
প্রতি কেজি বীজের জন্য ৮০ গ্রাম হারে অনুবীজ সার প্রয়োগ করতে হবে।
অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা
- চারা গজানোর পর আগাছা দেখা দিলে ১৫-২০ দিন পর নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিস্কার করে নিতে হবে।
- জলাবদ্ধতার আশঙ্কা থাকলে পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
- বপনের পর জমিতে রসের পরিমান কম বা অভাব হলে হালকা সেচ দিতে হবে।
- সেচের পর জো অবস্থায় মাটির উপরের শক্ত স্তর ভেঙে দিতে হবে।
- ফসলের জমিতে পোকা ও রোগের আক্রমণ দেখা দিলে তা দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
মাসকলাই চাষে রোগ ব্যবস্থাপনা
১. মাসকলাইয়ের পাতার দাগ রোগ
রোগের কারণ ও বিস্তার
সারকোম্পরা নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগটি হয়। পরিত্যক্ত ফসলের অংশ, বায়ু ও বৃষ্টির মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। অধিক আর্দ্রতা ও উচ্চতাপে এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে।
রোগের লক্ষন
আক্রান্ত পাতার উপর ছোট ছোট লালচে বাদামি গোলাকৃতি হতে ডিম্বাকৃতির দাগ পড়ে। আক্রান্ত অংশের কোষসমূহ শুকিয়ে যায় এবং পাতা ছিদ্র হয়ে যায়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে পাতা ঝলসে যায়।
প্রতিকার
রোগ প্রতিরোধী জাতের (পান্থ, শরৎ ও হেমন্ত) মাসকলাই চাষ করতে হবে। আক্রমণ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
২. পাউডারি মিলডিউ রোগ
রোগের কারণ ও বিস্তার
ওইডিয়াম প্রজাতির ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে। সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে এ রোগের অধিক প্রকোপ দেখা দেয়। বীজ, পরিত্যক্ত গাছের অংশ ও বায়ুর মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে।
রোগের লক্ষন
পাতার উপর পৃষ্টে পাউডারের মতো আবরণ পড়ে। হাতে স্পর্শ করলে পাউডারের গুঁড়ার মতো লাগে।
প্রতিকার
বিকল্প পোষক ও গাছের পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। টিল্ট বা থিওভিট প্রয়োগ করতে হবে। রোগমুক্ত বীজ বপন করতে হবে। ছত্রাকনাশক দ্বারা বীজ শোধন করে বপন করতে হবে।
৩. হলদে মোজাইক ভাইরাস
রোগের কারণ ও বিস্তার
মোজাইক ভাইরাস দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে। আক্রান্ত বীজ ও বায়ুর মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। সাদা মাছি এ রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে।
রোগের লক্ষন
কচি পাতা প্রথমে আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত পাতার উপর হলদে সবুজ দাগ পড়ে। দূর থেকে আক্রান্ত জমি হলদে মনে হয়।
প্রতিকার
রোগমুক্ত বীজ বপন করতে হবে। সাদা মাছি দমনের জন্য ম্যালাথিয়ন স্প্রে করতে হবে। আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে। রোগ প্রতিরোধী জাতের মাসকলাইয়ের চাষ করতে হবে।
পোকা ব্যবস্থাপনা
মাসকলাই ফসলে বিছা পোকার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। এ পোকা পাতা, অপরিপক্ব সবুজ ফলের রস খেয়ে ফেলে। পাতা সহ সমস্ত গাছ সাদা জালিকার মতো হয়ে যায়। ফলে ফলন কমে যায়।
এ পোকার আক্রমণ দেখা দিলে হাত দ্বারা সেগুলোকে সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে পরিমান মতো সাইপারমেথ্রিন ইসি ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
এছাড়া গুদামজাত মাসকলাই ডাল পূর্ণ বয়স্ক পোকা ও কীড়া উভয় ক্ষতি করে থাকে। এ পোকা ডালেত খোসা ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে শাঁস খেতে থাকে।
ফলে দানা হালকা হয়ে যায়। এর ফলে বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় এবং খাওয়ার অনুপোযুক্ত হয়ে যায়। বীজের জন্য টন প্রতি ৩০০ গ্রাম ম্যালাথিয়ন বা সেভিন শতকরা ১০ ভাগ গুঁড়া মিশিয়ে পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়।
ফসল কাটা, মাড়াই ও গুদামজাতকরণ
খরিপ -১ মৌসুমে মে মাসের শেষ এবং খরিপ -২ মৌসুমে অক্টোবর মাসের শেষে ফসল সংগ্রহ করা হয়। পরিপক্ব হলে সকালের দিকে ফসল সংগ্রহ করতে হবে।
প্রথম দিকে পরিপক্ব ফল হাত দিয়ে এবং শেষবারের বেলায় কাঁচি দিয়ে গাছগুলো গোড়া থেকে কেটে নিতে হবে। গাছগুলো রোদে শুকিয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বা গরু দিয়ে মাড়াই করে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
সংগৃহীত বীজ ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে পরিস্কার ও ঠান্ডা করে মাটি বা টিনের পাত্রে মুখ বন্ধ করে গুদামজাত করতে হবে।
ফলন
জাত ভেদে মাসকলাইয়ের গড় ফলন হেক্টর প্রতি ১.৫-২ টন হয়ে থাকে।