বাণিজ্যিকভাবে চাষ করুন সরিষা লাভ করুন বিপুল অর্থ
বাংলাদেশে সরিষা শীতকালীন ফসল। তাই সরিষাকেই প্রধান ভোজ্য তৈল বীজ ফসল হিসেবে বেশি চাষ করে থাকে। আসুন যেনে নিই সরিষা চাষ পদ্ধতি সর্ম্পকে।
বাংলাদেশের তেল ফসল হিসাবে সরিষা ,সয়াবিন, তিল, তিসি, চিনাবাদাম, সূর্যমুখী প্রভৃতির চাষ হয়ে থাকে। তবে এ দেশের কৃষকরা সরিষাকেই প্রধান ভোজ্য তৈল বিবেচনা করে এবং সরিষা বীজ ফসল হিসেবে বেশি চাষ করে থাকে। আর অর্জন করে বিপুল অর্থ ্নএ্ন্মই সরিষা চাষ করে। তাই আসুন জেনে নিই সরিষা চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে।
আরোও পড়তে পারেন – বারি সরিষা-১৪ চাষ পদ্ধতি
সরিষা চাষের জন্য জমি নির্বাচন
সরিষা চাষের জন্য বেলে দোআঁশ অথবা পলি দোআঁশ মাটি উপযোগী। অতএব, সহজে পানি নিকাশ করা যায় এরূপ বেলে দোআঁশ বা পলি দোঅঁশ মাটির জমি নির্বাচন করতে হবে।
সরিষার জাত নির্বাচন
অনেক জাতের সরিষার চাষ হয়। নিন্মে সরিষার অনুমোদিত কতগুলো জাতের নাম, যেমন: টরি-৭,কল্যাণীয়া, সোনালি সরিষা, সম্পদ, রাই সরিষা, বারি সরিষা-৮, বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৫, বারি সরিষা-১৬।
সরিষা বপনের সময়
বাংলাদেশে সরিষা শীতকালীন ফসল। বিভিন্ন অঞ্চলের তারতম্য এবং জমির “জো” অবস্থা অনুসারে টরি-৭,কল্যাণীয়া, সোনালি ও বারি সরিষা-৮ এর বীজ মধ্য আশ্বিন থেকে মধ্য কার্তিক মাস (অক্টোবর) পর্যন্ত বোনা যায়।
বারি-১৪, বারি-১৫ ও বারি-১৬ এর আশ্বিন মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে কার্তিক মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত বপন করা যেতে পারে।
আরোও পড়ুস – সরিষা খৈল তেরির নিয়ম জানুন | সরিষার খৈল তৈরি পদ্ধতি ও এর উপকারিতা
সরিষার চাষ পদ্ধতি
সরিষা চাষের জন্য জমি তৈরি
জমির প্রকারভেদ অনুযায়ী মাটির “জো” অবস্থায় ৪-৫ আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করে সরিষা চাষের জন্য জমি তৈরি করতে হবে। সরিষার বীজ ছোট বিধায় ঢেলা ভেঙ্গে মই দিয়ে মাটি সমান ও মিহি করতে হবে। জমির চারদিকে নালার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে প্রয়োজনে সেচ এবং পানি নিকাশের সুবিধা হয়।
সরিষা চাষে সার প্রয়োগ পদ্ধতি
জাত, মাটি ও মাটিতে রসের তারতম্য অনুসারে সরিষার জমিতে কমপোস্ট সার, ইউরিয়া, টিএসপি,এমওপি, জিপসাম, জিঙ্ক সালফেট, বোরাক্স/বোরিক ইত্যাদি সার সঠিক নিয়মে প্রয়োগ করতে হবে।
ইউরিয়া সারের অর্ধেকসহ বাকি সব সার জমি প্রস্তুত করার সময় মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হয়। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া ফুল আসার সময় উপরি প্রয়োগ করতে হয়। সার উপরি প্রয়োগের সময় মাটিতে রস থাকা দরকার।
আরোও জানতে পারেন – জৈব ও অজৈব সারের পার্থক্য
সরিষার বীজের হার
সরিষার জাত টরি-৭, কল্যাণীয়া, সোনালি সরিষা ও বারি সরিষা-৮ এর জন্য প্রতি শতকে ২৮-৩২ গ্রাম বীজ লাগে।
সরিষা বপন পদ্ধতি
- সরিষার বীজ সাধারণত ছিটিয়ে বোনা হয়। বীজ ছোট বিধায় বোনার সময় জমিতে সমানভাবে ছিটানো কষ্টকর হয়। এজন্য বালি বা ছাই এর যেকোনো একটি বীজের সাথে মিশিয়ে বীজ ছিটালে জমিতে সমান ভাবে পড়ে।
- এতে জমির কোন জায়গায় গাছ ঘন এবং কোন জায়গায় পাতলা হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। সারি করে সরিষার বীজ বোনা যায়। এতে সার, সেচ, নিড়ানি প্রভৃতি পরিচর্যা করতে সুবিধা হয়।
- এক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব সাধারণত ২৫-৩০ সেন্টিমিটার রাখা হয় ও প্রতি সারিতে ৪-৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে এবং২-৪ সেন্টিমিটার গভীরতায় বীজ বপন করা হয়। মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকলে ২-৩ দিনের মধ্যে চারা গজাবে।
আরোও জানুন – বারোমাসি বেগুন চাষ পদ্ধতি
সরিষা চাষে পরিচর্যা
সরিষার জমিতে নিন্মলিখিতভাবে পরিচর্যা করা হয়।
১) সরিষা চাষে পানি সেচ
মাটির আর্দ্রতা পর্যাপ্ত থাকলে সরিষার জমিতে সেচের প্রয়োজন হয় না। মাটির আর্দ্রতা বুঝে দুই থেকে তিনটি সেচ দিলে বেশ ভালো ফলন হয়। প্রথম সেচ বীজ বপনের ২০-২৫ দিন পর এবং দ্বিতীয়ত সেচ গাছের ফল হওয়ার সময় দিলে ভালো হয়।
বপনের পূর্বে যদি মাটি শুষ্ক থাকে তবে একটি হালকা সেচ দিয়ে জমি তৈরি করা উচিত। সরিষা জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। তাই সেচের পানি জমিতে জমে থাকতে দেওয়া উচিত নয়।
২) সরিষা গাছ পাতলাকরণ
চারা খুব ঘন হলে পাতলা করে দিতে হবে। জমির কোথাও চারা না গজালে প্রয়োজনে সেখানে বীজ আবার বপন করতে হবে। পাতলাকরণের কাজটি চারা গজাবার ১০-১৫ দিনের মধ্যে করতে হবে।
৩) সরিষা গাছের আগাছা দমন
সরিষার জমিতে আগাছা দেখা মাত্র নিড়ানি দিয়ে তুলে ফেলতে হবে। চারা পাতলা করার সময়ই আগাছা দমন করা যায়। যেসব জমিতে অরোবাংকির আক্রমণ দেখা যায় সে সব জমিতে পর পর দুই বছর সরিষা চাষ না করাই ভালো।
৪) সরিষার রোগের কারণ,লক্ষণ ও দমন
সরিষা ফসলের প্রধান রোগ অল্টারনারিয়া ব্লাইট বা পাতায় দাগ পড়া রোগ অন্যতম। এ রোগ দেখা দিলে গাছের পাতায় প্রথমে বাদামি পরে গাঢ় রঙের গোলাকার দাগ দেখা যায়। এ রোগের আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষা করতে হলে প্রতিরোধ হিসাবে সঠিক নিয়মে বপন করা দরকার।
৫) সরিষার পোকা মাকড় দমন
সরিষা প্রধান ক্ষতিকারক পোকা হলো জাবপোকা। বাচ্চাও পরিণত জাবপোকা সরিষার কান্ড,পাতা,পুষ্পমঞ্জরি, ফুল ও ফল থেকে রস চুষে খায় ফলে দাস দুর্বল হয়ে যায়। ফুল ও ফল ধারণ বাধাগ্রস্ত হয়।
ফল কুঁচকে ছোট হয়ে যায় এবং শতকরা ৩০-৭০ ভাগ ফলন কম হতে পারে। জানুয়ারি মাসে আক্রমণ সবচেয়ে বেশি হয়। জাবপোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য ম্যালাথিয়ন-৫৭ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি হারে মিশিয়ে সিঞ্চন যন্ত্রের সাহায্যে সরিষার ক্ষেতে ছিটাতে হবে।
আরোও পড়তে পারেন – জুম চাষ পদ্ধতি
সরিষা ফসল সংগ্রহ
যখন গাছের শতকরা ৭০-৮০ ভাগ সরিষার ফল খড়ের রং ধারণ করে এবং গাছের পাতা হলদে হয় তখনই ফসল সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। সকালে ঠান্ডা আবহাওয়ায় শিশিরভেজা অবস্থায় ফসল সংগ্রহ করা উত্তম। মূলসহ গাছ টেনে তুলে অথবা কাঁচির দ্বারা কেটে ফসল সংগ্রহ করা যায়। তবে টেনে তোলাই ভালো।
সরিষার ফসল মাড়াই
সরিষা ফসল সংগ্রহের পর ৩-৪ দিন রোদে শুকিয়ে মাড়াই করতে হবে। কিছু কিছু অপুষ্ট থাকতে পারে।অপুষ্ট বীজগুলোকে আলাদা করতে হবে।
সরিষার বীজ শুকানো ও সংরক্ষণ
সরিষা মাড়াই করার পর বীজ ঝেড়ে রোদে ভালোভাবে ৩-৪ দিন শুকিয়ে নেওয়ার পর শুষ্ক পাত্রে সংরক্ষণ করা উত্তম। সংরক্ষিত বীজ মাঝে মধ্যে শুকিয়ে আবার সংরক্ষণ করতে হবে। রোদে শুকানো বীজ গরম অবস্থায় সংরক্ষণ করলে বীজের অঙ্কুরোদমন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।
তাই রোদে শুকানো বেশ ঠান্ডা করে প্লাস্টিক পাত্রে, টিনে বা ড্রামে রেখে মুখ ভালোভাবে বন্ধ করতে হবে যেন পাত্রের ভিতরে বায়ু প্রবেশ করতে না পারে।
সরিষার ফলন
বাংলাদেশ সরিষার ফলন প্রতি শতকে প্রায় ৩ থেকে ৩.৫ কেজি।
আরো পড়ুন – জিরা চাষ পদ্ধতি
সরিষা ফসলের গুরুত্ব
- বাংলাদেশের তিন প্রকার সরিষা চাষ হয়। যথা : টরি,শ্বেত ও রাই। বিভিন্ন জাতের সরিষার বীজে ৪০-৪৪% তেল থাকে।
- সরিষার বীজ থেকে তৈল নিষ্কাশনের পর যে খৈল থাকে তাতে প্রায় ৪০% আমিষ এবং ৬৪% নাইট্রোজেন থাকে। সরিষার খৈল গরু, মহিষের জন্য খুবই পুষ্টিকর খাদ্য এবং উৎকৃষ্ট জৈব সার।
- এছাড়া রান্নার কাজে সরিষার তেল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আবার সরিষার জমিতে কৃত্রিম উপায়ে অত্যন্ত অল্প খরচে মৌমাছি পালন করে মধু সংগ্রহ করা যায়।
- এজন্য সরিষাকে মধু উদ্ভিদও বলা হয়। কাজেই অর্থনৈতিক, ঔষধশিল্প ও কৃষিক্ষেত্রে সরিষা ফসল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
FAQs
বিঘা প্রতি সরিষার ফলন হয় ৭-৮ মণ।
সরিষা চাষ এর সময় হলো মধ্য কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম সপ্তাহ বা নভেম্বর মাস পর্যন্ত।
সরিষা গাছের বৈশিষ্ট্য হলো সরিষা গাছের উচ্চতা হলো ৯৫-১০৫ সেমি এবং সরিষার প্রাথমিক শাখার সংখ্যা হয় ৩-৫টি, সরিষা ফুলের রং হলুদ, সরিষা বীজের রং লালচে।
সরিষা বীজের দাম হলো ৮০-১০০ টাকা।