জানুন এলোভেরা চাষ পদ্ধতি, সার ব্যবহার ও রোগবালাই নিয়ে
অ্যালোভেরা একটি ভেষজ গুণসম্পন্ন এবং অত্যন্ত উপকারি ঔষধি গাছ । যা বর্তমানে মানুষের বিভিন্ন রোগ সাধনে ও ত্বকের যত্নে বহুল পরিচিত।
এলোভেরা বা ঘৃতকুমারী আমাদের সবারই সুপরিচিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ ওষধি গাছ। দৈনন্দিন ব্যবহার্য বিভিন্ন প্রসাধনীতে প্রায়ই দাবি করা হয়ে থাকে এলোভেরার উপস্থিতির কথা।
অ্যালোভেরার জেল রূপচর্চা থেকে শুরু করে, বিভিন্ন প্রকার আয়ুর্বেদিক ঔষধি হিসাবেও ব্যবহার করা হয়। অ্যালোভেরাতে উপস্থিত অ্যান্টি- ইনফ্লেমেটরি উপাদান, ছোটখাটো পুড়ে যাওয়া বা কেটে যাওয়া ক্ষত স্থান গুলি খুব দ্রুত সারিয়ে তুলতে সক্ষম।
আসুন জানি অ্যালোভেরা চাষ করার নিয়ম ও রোগবালাই নিয়ে বিস্তারিত।
এলোভেরা চাষ পদ্ধতি
এলোভেরা চাষে মাটি ও জলবায়ু
সবরকম জমিতেই ঘৃতকুমারী চাষ সম্ভব। তবে দোঁ-আশ ও অল্প বালু মিশ্রিত মাটিতে গাছের বৃদ্ধি ভালো হয় । সুনিষ্কাশিত জমি যেসব জমিতে পানি জমে না এরূপ উঁচু জমিতে ঘৃতকুমারীর চাষ করা যায়।
তবে লবণাক্ত ও চরম অম্লীয় মাটিতে ভালো হয় না। নিচু ও পানি জমা জমিতে গাছ পচে যায়। যেকোনো দোআঁশ মাটিতে চাষ ভালো হয় তবে বেলে দোআঁশ মাটি উত্তম। এঁটেল মাটিতে চাষ না করা ভালো। ছায়া জায়গায় হবে না, ঘৃতকুমারীর জন্য দরকার সারা দিন রোদ।
এলোভেরা চাষের জমি তৈরি
ঘৃতকুমারী চাষ করতে হলে জমি প্রথমে ভালোভাবে পরিষ্কার করে চাষ দিতে হবে। চাষের সময় হেক্টরপ্রতি ১০ থেকে ১২ টন গোবর মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
এ ছাড়া এ সময় হেক্টরপ্রতি ২২৫ থেকে ২৫০ কেজি টিএসপি ও ৭৫ থেকে ১০০ কেজি এমওপি সার দিতে হবে। অ্যালোভেরা চাষিরা সাধারণত বেশি করে গোবর সার দিয়ে এর চাষ করেন, খুব কম চাষিই রাসায়নিক সার দেন।
সার মেশানোর পর জমিতে চারা লাগানোর জন্য বেড তৈরি করতে হবে। বেড হবে ১.৫ থেকে ২.২৫ মিটার চওড়া। প্রতি দুই বেডের মাঝে ৪০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার নালা রাখতে হবে।
অ্যালোভেরার চারা রোপণ
ঘৃতকুমারীর তিন রকম চারা লাগানো হয়। বাণিজ্যিকভাবে রুট সাকার লাগানো লাভজনক নয় বিধায় এটি লাগানো হয় না। পুরনো গাছের গোড়া থেকে গজানো চারা মাতৃগাছ থেকে আলাদা করে প্রথমে একখণ্ড জমিতে বা বেডে লাগানো হয়।
সেখানে এসব চারা দুই থেকে তিন মাস লালন পালন করে বড় করা হয়। পরে মূল জমি চাষ দিয়ে এসব চারা তুলে সেখানে লাগানো হয়। এতে চারার প্রতিষ্ঠা ভালো হয়।
তবে এরূপ চারা লাগিয়ে পাতা তোলার জন্য ছয় মাস অপেক্ষা করতে হয়। তাই বাণিজ্যিক চাষের জন্য এরূপ চারা লাগানোর চেয়ে মোথা কেটে বাদ দিয়ে সরাসরি পুরনো গাছ লাগাতে বেশি পছন্দ করে থাকেন। এতে দ্রুত পাতা তোলা যায়।
এ রকম গাছ লাগানোর তিন মাসের মাথায় পাতা তোলা যায়। লাগানো গাছ যেন সুস্থ সবল হয় সে দিক লক্ষ রাখতে হবে।
এলোভেরার চারা রোপণের সময়
বছরের যেকোনো সময় ঘৃতকুমারীর চারা লাগানো যায়। জুন/আষাঢ় মাসের শুরুতে গাছ লাগালে তা বাড়ে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি। তবে শীত ও বর্ষাকালে চারা না লাগানো ভালো।
সাধারণত কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে চারা বেশি লাগানো হয়। কেননা এ সময় চারা লাগালে শীতের মধ্যে গাছ মাটিতে লেগে যাওয়ার চেষ্টা করে।
শীতের সময় বাজারে অ্যালোভেরার পাতার চাহিদা থাকে না। তাই চাষিরা এ সময় পাতা সংগ্রহ থেকে বিরত থাকেন। পক্ষান্তরে এই ২-৩ মাসের মধ্যে চারা জমিতে ভালোভাবে লেগে যায়।
শীত শেষে বসন্তে নতুন পাতা ছাড়তে শুরু করলে পাতা সংগ্রহ করা শুরু হয়। এ পদ্ধতিতে চাড়া রোপণ করলে বেশি পাতা পাওয়া যায়।
অ্যালোভেরার চারা রোপণের দূরত্ব
চারা সারি করে লাগানো হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব সাত ইঞ্চি ও প্রতি সারিতে ছয় ইঞ্চি পর পর চারা লাগানো হয়। ১.৫ মিটার চওড়া বেডে দুই সারিতে ও ২.২৫ মিটার চওড়া বেডে তিন সারিতে চারা রোপণ করা হয়। এক বিঘা জমিতে প্রায় তিন হাজার ছয়শোটি গাছ লাগানো যায়।
অ্যালোভেরা চাষে সার ও সেচ প্রয়োগ
সাধারণত কোনো রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয় না। রাসায়নিক সারের পরিবর্তে ব্যবহার করতে হবে খৈল বা নিম খৈলের মত জৈব সার। জমি প্রস্তুত করে নিয়ম অনুযায়ী ঘৃত কুমারি চাষ করতে হয়।
সাধারনত ভেজা জমিতে ঘৃত কুমারি ভালো বাড়ে। নিয়মিত সেচের দরকার হলেও গাছের গোড়ায় যাতে পানি থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
যদি ইউরিয়া সার দিতে হয় তাহলে বছরে একবার সবটুকু ইউরিয়া সার জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে জমিতে ছিটিয়ে দিলেই চলে। সার ছিটানোর পর আগাছা নিড়িয়ে মাটির সাথে সার মিশিয়ে দিতে হয়।
বেশি ইউরিয়া সার দিলে রোগের আক্রমণ ও প্রকোপ বেড়ে যায়। শুষ্ক মওসুমে জমিতে প্রয়োজন মাফিক সেচ দিতে হবে। মাঝে মাঝে জমির আগাছা নিড়িয়ে দিতে হবে।
ঘৃতকুমারী গাছ জমিতে প্রায় দুই বছর থাকে। তাই দ্বিতীয় বছরেও প্রথম বছরের মতো একই হারে জমিতে সার ও সেচ দিতে হবে।
অ্যালোভেরা চাষে রোগবালাই ব্যবস্থাপনা
১) পাতার দাগ রোগ
অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারী গাছে পাতায় দাগ পড়া এক প্রধান সমস্যা। শীতকালে এ রোগ কম থাকে। কিন্তু শীত শেষে ফাল্গুন মাসে এ রোগের প্রকোপ বেড়ে যায় এবং পাতার ব্যাপক ক্ষতি হয়।
এ রোগের আক্রমণে পাতার অগ্রভাগে আলপিনের মাথার মতো ক্ষুদ্র এক বিন্দুর মতো দাগ পড়ে, সেখান থেকে আঠার মতো কষ বের হয়। ওই আঠা শুকিয়ে বাদামি দাগের সৃষ্টি করে।
এভাবে আক্রান্ত গাছের পাতায় ধীরে ধীরে দাগ বড় হতে থাকে ও দাগের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এটি ধারণা করা হয় ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ, তাই ছত্রাকনাশক প্রয়োগে তেমন ফল পাওয়া যায় না।
এ রোগের কারণে পাতার চেহারা নষ্ট হয়ে যায়। বাজারমূল্যও কমে যায়। তবে যারা বাণিজ্যিকভাবে ঘৃতকুমারী চাষ করেন তারা ১৫ দিন পরপর চুন পানিতে গুলে স্প্রে করে থাকেন।
২) গোড়া পচা রোগ
গোড়া পচা রোগে গাছের গোড়া পচে যায়। পরে গাছ মারা যায়। বর্ষাকালে ও গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকলেও বা ভেজা থাকলে গোড়া পচা রোগ হয়। ছত্রাকনাশক (নোইন, এমিস্টারটপ, রিডোমিল্ড গোল্ড, এসিবিন) স্প্রে করলে এ রোগের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যায়।
ফসল সংগ্রহ ও ফলন
ঘৃতকুমারী চারা লাগানোর দুই তিন মাস পর থেকেই গাছের পাতা পাতা তোলা শুরু করা যায়। একটি গাছে থেকে ৬০- ৭০ টি পাতা বিক্রি করা যায় এবং সারা বছর জুড়ে এর থেকে নতুন নতুন পাতা জন্মে।
বছরে ৯-১০ মাস পাতা তোলা যায়। শীতকালে পাতা তোলা বন্ধ থাকে। সাধারণত প্রতি ১৫ দিনে একটি পাতা বের হয়। তবে চাষিরা মাসে একটি গাছ থেকে ১-২টি পাতা সংগ্রহ করে।
গাছের বৃদ্ধি ও পাতা বড় হলে প্রতি মাসে দু’টি পাতা তোলা যায়। পাতা তোলার পর পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করে ছায়ায় শুকিয়ে আঁটি বেঁধে বাজারে বিক্রি করা যায়।
কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য ও পরামর্শ, ফসলের চাষ পদ্ধতি, সার প্রয়োগ এবং ফসলের বিভিন্ন রোগ বালাই সম্পর্কে জানতে নিয়মিত ভিজিট করূন Krishakbd.com