চিচিঙ্গা চাষ পদ্ধতি ও চিচিঙ্গা-র উপকারিতা
চিচিঙ্গা একটি অন্যতম প্রধান গ্রীষ্মকালীন সবজি। এটি খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু এবং ঔষধী গুণ সম্পন্ন। আসুন জেনে নিই চিচিঙ্গা চাষের সঠিক পদ্ধতি।
ঝিঙের মত কিন্তু আরও লম্বা বা কখনো সাপের মত পেঁচানো, অপেক্ষাকৃত নরম সবজি হলো চিচিঙ্গা। চিচিঙ্গা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান গ্রীষ্মকালীন সবজি। এর অনেক ঔষধী গুণ রয়েছে।
তাই আসুন জেনে নিই চিচিঙ্গা চাষের সঠিক পদ্ধতি।
চিচিঙ্গা ইংরেজি কি?
চিচিঙ্গা-র ইংরেজি হলো – “Snake gourd”
চিচিঙ্গার উন্নত জাত
- সুরমা এফ-১
- তিস্তা, বারি চিচিঙ্গা-১
চিচিঙ্গার পুষ্টিগুন
চিচিঙ্গা বাংলাদেশের সকলের নিকট প্রিয় অন্যতম প্রধান গ্রীষ্মকালীন সবজি। এর অনেক ঔষধী গুণ আছে। চিচিঙ্গার ১০০ ভাগ ভক্ষণযোগ্য অংশে ৯৫ ভাগ পানি, ৩.২-৩.৭ গ্রাম শর্করা, ০.৪-০.৭ গ্রাম আমিষ, ৩৫-৪০ মিঃগ্রাঃ ক্যালসিয়াম, ০.৫-০.৭ মিঃগ্রাঃ লৌহ এবং ৫-৮ মিঃগ্রাঃ খাদ্যপ্রাণ সি আছে।
চিচিঙ্গার বীজ বপনের সময়
ফেব্রুয়ারি-জুন মাস পর্যন্ত চিচিঙ্গা চাষের উপযুক্ত সময়।
চিচিঙ্গা চাষ পদ্ধতি
চিচিঙ্গা চাষে জমি তৈরি
চাষের জন্য প্রথমে সম্পূর্ণ জমি ৪-৫ বার চাষ ও মই দিয়ে প্রস্তুত করে নিতে হয় যাতে শিকড় সহজেই ছড়াতে পারে। জমি বড় হলে নির্দিষ্ট দূরত্বে নালা কেটে লম্বায় কয়েক ভাগে ভাগ করে নিতে হয়।
চিচিঙ্গা চাষে বীজের পরিমান
জাত ভেদে শতক প্রতি ১২ – ১৫ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
চিচিঙ্গা চাষে সার ব্যবস্থাপনা
সারের নাম | শতক প্রতি সার |
কম্পোস্ট | ৮০ কেজি |
ইউরিয়া | ৭০০ গ্রাম |
টিএসপি | ৭০০ গ্রাম |
পটাশ | ৬০০ গ্রাম |
জিপসাম | ৪০০ গ্রাম |
চিচিঙ্গা চাষে সার প্রয়োগ পদ্ধতি
২০ কেজি গোবর, অর্ধেক টিএসপি ও ২০০ গ্রাম পটাশ, সমুদয় জিপসাম, দস্তা, বোরণ জমি তৈরির সময় মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে। অবশিষ্ট গোবর (মাদা প্রতি ৫ কেজি), টিএসপি (মাদা প্রতি ৩০ গ্রাম), ২০০ গ্রাম পটাশ (মাদা প্রতি ২০ গ্রাম), সমুদয় ম্যাগনেসিয়াম (মাদা প্রতি ৫ গ্রাম) চারা রোপণের ৭-১০ দিন পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে।
চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর ১ম বার ২০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ২০০ গ্রাম পটাশ (মাদা প্রতি ১৫ গ্রাম), ৩০-৩৫ দিন পর ২য় বার, ৫০-৫৫ দিন পর ৩য় বার ২০০ গ্রাম করে ইউরিয়া (মাদা প্রতি ১৫ গ্রাম) প্রয়োগ করতে হবে। চারা রোপণের ৭০-৭৫ দিন পর ১০০ গ্রাম ইউরিয়া (মাদা প্রতি ১৫ গ্রাম) প্রয়োগ করতে হবে।
চিচিঙ্গা চাষে সেচ পদ্ধতি
চিচিঙ্গা গ্রীষ্মকালে চাষ করা হয়। গ্রীষ্মকালে মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয় বলে তখন সবসময় পানি সেচের প্রয়োজন নাও হতে পারে।
কিন্তু ফেব্রুয়ারির শেষ সময় থেকে মে মাস পর্যন্ত খুব শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে। উক্ত সময়ে ৫-৬ দিন অন্তর নিয়মিত পানি সেচের প্রয়োজন হয়।
চিচিঙ্গা চাষে আগাছা দমন
জমি নিয়মিত জমি পর্যবেক্ষণ করুন । সেচ ও সার দেবার পর জো আসা মাত্র নিড়িয়ে আগাছা বাছাই করতে হবে । চারা গজানোর ২০-২৫ দিন পর আগাছা দমন করতে হবে।
গাছ খুব ঘন থাকলে পাতলা করে দিতে হবে। চারা অবস্থা থেকে রসুন গঠনের পূর্ব পর্যন্ত ২ থেকে ৩ বার নিড়ানি দিয়ে জমির আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে।
চিচিঙ্গা চাষে আবহাওয়া ও দুর্যোগ ব্যাবস্থাপনা
অতি বৃষ্টির কারনে জমিতে পানি বেশি জমে গেলে নালা তৈরি করে তাড়াতাড়ি পানি সরানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
চিচিঙ্গা চাষে পোকামাকড় দমন
১. রেড পামকিন বিটল
সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (যেমন ওস্তাদ ২০ মিলিলিটার অথবা ম্যাজিক অথবা কট ১০ মিলিলিটার) প্রতি ১০লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে ১০-১২ দিন পরপর ২/৩ বার স্প্রে করতে হবে। কীটনাশক স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
২. সুড়ঙ্গকারী পোকা
সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (যেমন ওস্তাদ ২০ মিলিলিটার অথবা ম্যাজিক অথবা কট ১০ মিলিলিটার) প্রতি ১০লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে ১০-১২ দিন পরপর ২/৩ বার স্প্রে করতে হবে। কীটনাশক স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
৩. জাব পোকা
হলুদ রং এর আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করুন।আক্রমণ বেশি হলে ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক (যেমন এডমায়ার অথবা টিডো ৭-১০ মিলিলিটার / ২মুখ) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে ১০ দিন পরপর ২/৩ বার। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
৪. ফলের মাছি পোকা
সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (যেমন ওস্তাদ ২০ মিলিলিটার অথবা ম্যাজিক অথবা কট ১০ মিলিলিটার) প্রতি ১০লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে ১০-১২ দিন পরপর ২/৩ বার। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
চিচিঙ্গা চাষে রোগবালাই ব্যাবস্থাপনা
১. ডাউনি মিলডিউ রোগ
ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক ( যেমনঃ রিডোমিল গোল্ড ১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে যেতে পারে। স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সবজি বিষাক্ত থাকবে। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
২. পাতায় দাগ রোগ
কপার অক্সিক্লোরাইড জাতীয় ছত্রাকনাশক ( যেমনঃ ডিলাইট ২০ গ্রাম) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে যেতে পারে। স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সবজি বিষাক্ত থাকবে। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
৩. চিচিঙ্গার পাতা কুঁকড়ানো রোগ
বাহক পোকা দমনের জন্য ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক (যেমন এডমায়ার অথবা টিডো ১০ মি.লি. ২ মুখ ) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
কীটনাশক প্রয়োগে সতর্কতা অবলম্বন
বালাইনাশক/কীটনাশক ব্যবহারের আগে বোতল বা প্যাকেটের গায়ের লেবেল ভালো করে পড়ুন এবং নির্দেশাবলি মেনে চলুন। ব্যবহারের সময় নিরাপত্তা পোষাক পরিধান করুন।
ব্যাবহারের সময় ধূমপান এবং পানাহার করা যাবে না। বালাইনাশক ছিটানো জমির পানি যাতে মুক্ত জলাশয়ে না মেশে তা লক্ষ্য রাখুন।
বালাইনাশক প্রয়োগ করা জমির ফসল কমপক্ষে সাত থেকে ১৫ দিন পর বাজারজাত করুন। বালাইনাশক/কীটনাশক ব্যাবহারের সময় নিরাপত্তা পোষাক পরিধান করুন।
ফলন
জাত ভেদে শতক প্রতি ফলন ১০০ – ১২০ কেজি হয়।
চিচিঙ্গা সংরক্ষন
ঠান্ডা ও বাতাস চলাচল করা জায়গাতে ফল ঘষা বা চাপ খায় না এমন ভাবে সংরক্ষণ করুন। বীজ বেশিদিন সংরক্ষণ করতে চাইলে নিমের তেল মিশিয়ে রাখতে পারেন। কিছুদিন পর পর বীজ হালকা রোদে শুকিয়ে নিবেন।
চিচিঙ্গা খাওয়ার উপকারিতা
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
- হৃদযন্ত্রের জন্য খুবই উপকারি
- ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে
- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে
- টাক পড়া রোধ করে
- হাড় ও দাঁত মজবুত করে
- কফ-কাশি দূর করে
- জ্বর সারিয়ে তোলে
- হজম শক্তি বৃদ্ধি করে
- শরীরের বিষাক্ত উপাদান দূর করে
- অ্যাসিডিটি দূর করে
- লিভারের জন্য খুবই উপকারী
কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য ও পরামর্শ, ফসলের চাষ পদ্ধতি, সার প্রয়োগ এবং ফসলের বিভিন্ন রোগ বালাই সম্পর্কে জানতে নিয়মিত ভিজিট করূন Krishakbd.com