তিল চাষের সঠিক ও সহজ পদ্ধতি
তিল বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম ভোজ্যতেল ফসল। এটি অত্যন্ত লাভজনক ফসল এবং আমাদের দেশে তিলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই আসুন জেনে নিই তিল চাষের সটিক পদ্ধতি।
বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদনে তেলজাতীয় ফসল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিল বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম ভোজ্যতেল ফসল।
যে জমিতে কোনো ফসল হয় না সে জমিতেও তিল চাষ করা যায়। আগে কৃষকরা তাদের পরিত্যক্ত জমিতে তিল চাষ করতেন।
এছাড়া অন্যান্য ফসলের বেড়া হিসেবেও জমির চারদিকে তিল লাগানো হতো। তিল চাষ যেমন সহজ তেমনই এটি একটি মূল্যবান ফসল। সহজে বাড়িতে সংরক্ষণও করা যায়।
আমাদের দেশে সাধারণত কালো ও খয়েরি রঙের বীজের তিলের চাষ বেশি হয়। তিলের বীজে ৪২-৪৫% তেল এবং ২০% আমিষ থাকে। তিলের তেলে মানব শরীরের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ৮০% এর বেশি অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড আছে।
আবহাওয়ার গতিবিধি বিবেচনায় সঠিক সময়ে সেচ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা, উন্নত জাতের ব্যবহার, উপযুক্ত পরিচর্যা এবং আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে তিলের ফলন প্রতি হেক্টরে ১২০০ – ১৫০০ কেজি পাওয়া সম্ভব।
আবহাওয়ার গতিবিধি বিবেচনা
বর্তমানে আবহাওয়ার কিছুটা বৈরী আচরণের কারণে তিল চাষে অধিক ফলনের জন্য আবহাওয়ার গতিবিধি বিবেচনায় রেখে তিল বপনের তারিখ খুবই গুরুত্বপূর্ণ তিল রবি (১৬ অক্টোবর-১৫ মার্চ বা কার্তিক-ফাল্গুন) ও খরিফ উভয় মৌসুমে চাষ করা যায়।
খরিফ-১ মৌসুমে অর্থাৎ ফাল্গুন-চৈত্র মাসে (মধ্য-ফেব্রুয়ারি হতে মধ্য-এপ্রিল), খরিফ-২ মৌসুমে অর্থাৎ ভাদ্র মাসে (মধ্য-আগস্ট হতে মধ্য-সেপ্টেম্বর) তিলের বীজ বপনের উত্তম সময়।
যদি মধ্য ফেব্রুয়ারির মধ্যে তিল বপন করা যায় তবে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝাড় এবং ফুল আসা পর্যায়ের শুরুতে কিংবা শেষে অথবা ফলধারণ পর্যায় অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা এড়িয়ে মধ্য এপ্রিলের মধ্যে ফসল সংগ্রহ সম্ভব হয়।
তিল চাষে অধিক ফলন পেতে সব এলাকার জন্য তিল বপনের উপযোগী সময় ১৫-২০ ফেব্রুয়ারি। এই সময়ে বপন করলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝড় এবং অতিবৃষ্টি এড়ানো সম্ভব।
এই সময়ে বীজ অঙ্কুরোদগমের উপযুক্ত তাপমাত্রা ২৫° সেলসিয়াস বা এর বেশি বিরাজ করে তাই বীজ অঙ্কুরোদগম এবং চারা ঠিকমতো বাড়তে কোন সমস্যা হয় না।
তিলের চাষাবাদ পদ্ধতি
তিল চাষে মাটির ধরন
পানি জমে থাকে না এমন প্রায় সব ধরনের মাটিতে তিলের চাষ করা যায়। উঁচু বেলে দো-আঁশ বা দো-আঁশ মাটি তিল চাষের জন্য বেশি উপযোগী।
তিল চাষে জমি তৈরি
তিল চাষের জন্য মাটি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে ভালভাবে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে।
তিলের বীজ বপনের সময়
তিল ঘরিফ ও রবি উভয় মৌসুমেইাচাষ করা যায়। খরিফ-১ মৌসুমে অর্থাৎ ফাল্গুন-চৈত্র মাসে (মধ্য-ফেব্রুয়ারি হতে মধ্য-এপ্রিল), খরিফ-২ মৌসুমে অর্থাৎ ভাদ্র মাসে (মধ্য-আগষ্ট হতে মধ্য-নভেম্বর) তিলের বীজ বপনের উত্তম সময়।
তিলের বীজ বপন পদ্ধতি
তিলের বীজ সাধারণত ছিটিয়ে বপন করা হয়। তবে সারিতে বপন করলে অমত্মবর্তীকালীন পরিচর্যা করতে সুবিধা হয়। সারিতে বপন করলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সেমি ও গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৫ সেমি রাখতে হবে।
তিল চাষে তিলের জাত নির্বাচন
অধিক ফলন পেতে উন্নত জাত যেমন – বিনা তিল-২, বিনা তিল-৩, বিনা তিল-৪, বারি তিল-৩ এবং বারি তিল-৪ খুবই উপযোগী। তবে জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু বিবেচনায় বিনা তিল-৪, বিনা তিল-৩ এবং বারি তিল-৪ তুলনামূলক অধিক উপযোগী ।
বপন পদ্ধতি অনুসারে বীজের হার
ছিটিয়ে বপনের ক্ষেত্রে হেক্টর প্রতি ৮-৯ কেজি (বিঘা প্রতি ১-১.১৫ কেজি) এবং সারিতে বপনের ক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি ৭.০-৭.৫ কেজি (বিঘা প্রতি ১ কেজি)। সারিতে বপন করলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫-৩০ সেমি. ও গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৫ সেমি. রাখতে হবে।
তিল চাষে সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি
সারের নাম | সারের পরিমান (হেক্টর প্রতি) |
ইউরিয়া | ১২০-১৬০ কেজি |
টিএসপি | ১৪০-১৫০ কেজি |
এমওপি | ৬০-৭০ কেজি |
জিপসাম | ১০০-১২৫ কেজি |
জিংক সালফেট (প্রয়োজনে) | ৪-৬ কেজি |
বরিক এসিড (প্রয়োজনে) | ৮-১০ কেজি |
ইউরিয়া সারের অর্ধেক ও বাকি সব সার জমি শেষ চাষের সময় ছিটিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি ইউরিয়া বীজ বপনের ২৫-৩০ দিন পর ফুল আসার সময় উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
তিল চাষে সেচ প্রয়োগ ও পানি নিষ্কাশন
ফসলের ক্ষেত্রে পানি ব্যবস্থাপনা বলতে কাঙ্ক্ষিত ফলনের জন্য জমিতে প্রয়োজনীয় সেচ বা অতিরিক্ত পানি অপসারণকে বোঝায়। সাধারণত খরিফ-১ মৌসুমে তিল বোনার সময় মাটিতে প্রায়ই রসের অভাব পরিলক্ষিত হয়।
মাটিতে পর্যাপ্ত রস বা আর্দ্রতা না থাকলে বীজ গজানোর বিষয়টি নিশ্চত করতে বপনের পূর্বে জমিতে অবশ্যই একটি সেচ দিতে হবে এবং মাটিতে জো আসার পর চাষ দিয়ে বীজ বপন করতে হবে।
তিল ফসল খরা সহনশীল হলেও ফুল আসার সময় জমিতে রসের অভাব হলে (সাধারণত বীজ বোনার ২৫-৩০ দিন পর) ফুল আসার পূর্বে এক বার সেচের প্রয়োজন হয়। জমিতে রস না থাকলে ৫৫-৬০ দিন পর ফল ধরার সময় আর একবার সেচ দিতে হবে।
উল্লেখ্য যে, তিল ফসল দীর্ঘ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। সাধারণত ৪৮-৫২ ঘণ্টার বেশি একটানা জলাবদ্ধতা থাকার পর তিল গাছ পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে পারে না।
আর এ অবস্থার পর যদি ৩-৫ দিন রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া বিরাজ করে তবে তিল গাছ মারা যায়। জলাবদ্ধতা বা অতিরিক্ত আর্দ্রতা তিল চাষের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এক্ষেত্রে দ্রুত গোড়াপচা রোগ হয়ে তিলগাছ মারা যায়। এজন্য জমি প্রস্তুতের সময় পানি নিষ্কাশনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তাই জমির মধ্যে মাঝে মাঝে নালা কেটে বৃষ্টি বা সেচের অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে ফসলকে রক্ষা করতে হবে।
তিল চাষে অন্যান্য পরিচর্যা
রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন
১. কাণ্ডপচা রোগ – কলেটোট্রিকাম ডেমাশিয়াম নামক ছত্রাক থেকে এ রোগ সৃষ্টি হয়। জমিতে কাণ্ডপচা রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে বাজারে যে সকল ছত্রাকনাশক পাওয়া যায়, যেমন ব্যাভিস্টিন বা ডাইথেন এম-৪৫ দুই গ্রাম হারে বা রোভরাল এক গ্রাম হারে প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ৮-১০ দিন পর পর তিনবার দুপুর ২-৩ ঘটিকার সময় ফসলে স্প্রে করে রোগটি দমন করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে উত্তম হবে, জমিতে জলাবদ্ধতা বা অতিরিক্ত আর্দ্রতা লক্ষ্য করা মাত্র ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করা।
২. বিছাপোকা ও হক মথ – এ পোকা তিল গাছে আক্রমণ করে ক্ষতি করে থাকে। এ পোকা ডিম পাড়ার পর অথবা ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার সাথে সাথে ডিমসহ পাতা ছিঁড়ে পানি মিশ্রিত কেরোসিন বা ডিজেলে ডুবিয়ে মেরে ফেলা যেতে পারে। পোকার আক্রমণ বেশি হলে সেভিন ৮৫ এসপি কীটনাশকের ৩৪ গ্রাম পাউডার প্রতি ১০ লিটার পানিতে অথবা অ্যাডভান্টেজ ২০ এসসি এর ৩০ মিলিলিটার প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত জমিতে স্প্রে করতে হবে। তিলের হক মথ দমনের ক্ষেত্রেও বিছাপোকা দমনের ন্যায় একই পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, বৈরী আবহাওয়ায় সঠিক সময়ে বপন, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা এবং আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে তিলের ফলন বাড়ানোর মাধ্যমে ভোজ্যতেলের চাহিদা অনেকাংশে মেটানো সম্ভব।
কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য ও পরামর্শ, ফসলের চাষ পদ্ধতি, সার প্রয়োগ এবং ফসলের বিভিন্ন রোগ বালাই সম্পর্কে জানতে নিয়মিত ভিজিট করূন Krishakbd.com