আলু সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ পদ্ধতি

আলু উৎপাদনের পাশাপাশি আলু সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনায় বিশেষ নজর না দিলে ক্ষতি হতে পারে। তাই আসুন জেনে নিই আলু সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ পদ্ধতি।

আলু

বাংলাদেশে আলুর উৎপাদন এখন কোটি টন ছাপিয়ে আলু উৎপাদনে বিশ্বে ৭ম স্থানে বাংলাদেশ। বর্তমানে দেশে আলুর চাহিদার প্রায় ৩০ ভাগ অধিক উৎপাদন হয়।

২০২০-২১ অর্থবছরে আলু রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে ১১.৬৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১০০ কোটি (১৭ এপ্রিল ২০২১, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড)।

আলুর বহুবিধ ব্যবহার ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। চিপস্, ক্রিপস, ফ্লেক্স, ফ্রেন্সফ্রাই স্টার্চ পাউডার ইত্যাদি তৈরিতে আলু ব্যবহার হচ্ছে এবং দিন দিন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।

রপ্তানির মাধ্যমে আলুর নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে। সরকার আলু রপ্তানি খাতে ২০% আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করেছে। আলুর গুরুত্ব অনেক গুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বীজ আলু, খাবার আলু, আগাম আলু, প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য আলু, রপ্তানিযোগ্য আলুসহ বিভিন্ন রকমের আলু দরকার।

আলু উৎপাদনের পাশাপাশি আলু সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনায় বিশেষ নজর না দিলে ক্ষতি হতে পারে। আবার সঠিকভাবে সংরক্ষণের অভাবে প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আলু পচে নষ্ট হয় বা গুণাগুণ নষ্ট হয়।

তাই আলুর সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণে কোন কোন বিষয়ের ওপর গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে তা আলোচনা করা হলো।

আলু সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা

টিউবারের পরিপক্বতা

পরিপক্ক আলুর চেয়ে অপরিপক্ব আলুর সংরক্ষণ ক্ষমতা কম পরিপক্ব আলুর চামড়া শক্ত থাকায় ওজন হ্রাস ধীরগতিতে হয়ে থাকে এবং রোগজীবাণু সহজেই আক্রমণ করতে পারে না।

সেজন্য আলু পরিপক্ক হওয়ার পর উত্তোলন করতে হবে। আলু উত্তোলনের কমপক্ষে ৭-১০ দিন আগে আলুর গাছ উঠিয়ে ফেলতে হবে।

একে হাম পুলিং (Haulm pulling) বলে। এতে আলুর চামড়া শক্ত হওয়ার সুযোগ পায়।

আলু তোলার সময়

আলু শীত-শীত ভাব থাকা অবস্থায় সংগ্রহ করা ভালো। কারণ গরম পড়া শুরু হলে বিভিন্ন রোগজীবাণু খুবই সক্রিয় হয়ে উঠে এবং আলুতে আক্রমণ করে।

মেঘলা বা বৃষ্টির দিনে আলু তোলা ঠিক নয়। তাছাড়া আলু দুপুরের দিকে না উঠিয়ে সকালের দিকে উত্তোলন করতে হবে। জমিতে জো থাকা অবস্থায় আলু সংগ্রহ করা উত্তম।

ফসল অবশ্যই পরিপক হলে সংগ্রহ করতে হবে। তাহলে আলুর ড্রাই মেটার বৃদ্ধি পাবে এবং রিডিউসিং সুগারের পরিমাণ কম হবে।

টিউবারের এই সম্মিলিত গুণাগুণ ফ্রেন্সফ্রাই এবং চিপসের জন্য উপযোগী। টিউবার মাটি থেকে উঠানোর সময় মারাত্মকভাবে এর গুণাবলি নষ্ট হয়ে থাকে।

টিউবার সংগ্রহের সময় মাটির তাপমাত্রা কম হলে টিউবারের আঘাতের ফলে সৃষ্ট কালো দাগ বেশি হয়। ১২°C এর নিচে মাটির তাপমাত্রা হলে টিউবার উঠানো উচিত নয়।

সংগ্রহকালীন সতর্কতা

আলু সংগ্রহের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন আলু কেটে না যায়, চামড়া না ছিড়ে যায় এবং দূর বা উঁচু থেকে নিক্ষেপ না করা হয়। কারণ তাতে আলু আঘাত পেতে পারে ।

তাছাড়া আলু উত্তোলনের সময় বাঁশের টুকরীতে না রেখে এ্যালুমিনিয়াম বা প্লাস্টিকের বোল ব্যবহার করতে হবে। বাঁশের টুকরীতে রাখতে হলে তাতে চট বিছিয়ে নিতে হবে।

আলু জমি থেকে তোলার পর রোদে বেশিক্ষণ রাখা ক্ষতিকারক। আলু উত্তোলনের পর যদি মাঠে রাখতেই হয় তবে পলিথিন বা ত্রিপাল দিয়ে ঢেকে রাখা যাবে না।

সেক্ষেত্রে শুকনা খড় বা কচুরিপানা বা পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে যাতে বায়ু চলাচল স্বাভাবিক থাকে। বৃষ্টি হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য আলুর স্তূপের উপর অস্থায়ী শেড নির্মাণ করা যেতে পারে।

ফসল স্থানাস্তর ও পরিবহন

বস্তা ভর্তি আলু হিমাগারে রাখলে আঘাতজনিত কালচে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এই ক্ষতযুক্ত আলু চিপস্‌ এবং ফ্রেন্সফ্রাই তৈরির অনুপযোগী ।

কিন্তু যদি আলু কাঠের বাক্সে করে হিমাগারের সংরক্ষণ করা হয় তাহলে উক্ত সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। আলুর পরিবহনে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

আলুর বস্তা পরিবহনের সময় সাবধানে নাড়াচাড়া করতে হবে, জোরে বা মাথা থেকে হঠাৎ ফেলে দেয়া যাবে না। একস্থান হতে অন্যস্থানে নেয়ার সময় কোন অবস্থাতেই বস্তার উপর বসা বা দাঁড়ানো যাবে না।

কিউরিং, বাছাই ও গ্রেডিং

সদ্য তোলা আলুকে ১৫-২০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় এবং শতকরা ৮৫ ভাগ আপেক্ষিক আর্দ্রতায় ৭-১০ দিন রেখে দিলে আলুর ক্ষত নিরাময় ও চামড়া শক্তকরণ প্রক্রিয়া দ্রুততর হয়। এ জন্য আলুক্ষেত থেকে আনার পর ছায়াযুক্ত স্থানে ছড়িয়ে রেখে মুক্ত বাতাসের ব্যবস্থা করতে হবে।

আলুকে সংরক্ষণের আগে ভালোভাবে বাছাই করতে হবে যেন খারাপ, কাঁটা, রোগাক্রান্ত বা ভেজা আলু গুদাম ঘরে না যায়। প্রয়োজনে আলুর আকার অনুযায়ী গ্রেডিং করতে হবে।

আলু সংরক্ষণ পদ্ধতি

প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে ব্যবহৃত আলু সংরক্ষণ

উপযুক্ত পরিবেশে আলু ৭-৯ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে ব্যবহৃত আলু সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যেসব বিষয়গুলো বিবেচনা করার উচিত সেগুলো হলো –

আলুর ওজন হ্রাস ও কালচে দাগ প্রতিরোধ করে হিমাগারের বায়ু চলাচল সর্বোনিম্ন পর্যায়ে রাখতে হবে এবং হিমাগারের অভ্যন্তরের আর্দ্রতা ৯২% এর বেশি রাখা দরকার।

চিপস্ তৈরিতে ব্যবহৃত আলুকে ৭-১০°C তাপমাত্রায় এবং ফ্রেন্সফ্রাই জন্য ব্যবহৃত আলুকে ৬-৭°C তাপমাত্রায় সংরক্ষণ উচিত।

আলুর স্প্রাউট গজানো বন্ধ করতে IPC (আইসোপ্রপাইল-৩ ক্লোরোফিনাইল কার্বোনেট) অথবা কেওড়া বীজের নির্যাস ব্যবহার করা যেতে পারে।

আলু হিমাগার থেকে বের করে প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় রাখার পূর্বে ১৫-১৮°C তাপমাত্রায় তিন দিন রাখলে কালো দাগজনিত রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

প্রক্রিয়াকরণ কারখানা ব্যবহৃত আলুর গুণাগুণ নিরূপণের মানদণ্ডসমূহ সাধারণত আকার, আকৃতি, রোগবালাই, আঘাতজনিত কালচে ক্ষত, শুষ্ক পদার্থের পরিমাণ এবং চিনির উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের জন্য উপযুক্ত আলুর জাত নির্বাচন করা।

হিমাগারে বীজ আলু সংরক্ষণ

বীজ আলু অবশ্যই হিমাগারে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ আলু ৪০ কেজির অধিক ওজনের বস্তায় সংরক্ষণ করা যাবে না। আলু সংরক্ষণের পূর্বে কোল্ডস্টোরেজের কক্ষগুলো ভালোভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে।

ব্লিচিং পাউডার ও বর্দো মিকচার ব্যবহার করে কোল্ড স্টোরেজের কক্ষগুলো পরিষ্কার করা হয়ে থাকে। কোল্ডস্টোরেজে দুই ধরনের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থাকে ।

১. প্রিকুলিং/প্রিহিটিং চেম্বার – মাঠ হতে বীজ আলু সংগ্রহের পর কোল্ডস্টোরেজের মূল কক্ষে প্রবেশের পূর্বে আর্দ্রতা কমানোর জন্য এ কক্ষে রাখা হয়।

এ কক্ষের তাপমাত্রা ১৫-১৮ ডিগ্রি সে. হয়ে থাকে। মূল কক্ষে সংরক্ষণের পূর্বে এ কক্ষে কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত বীজ রাখা উচিত।

এ চেম্বারেই আলু হিমাগার হতে বের করার পর স্বাভাবিক তাপমাত্রায় নিয়ে আসার আগে একই পদ্ধতিতে প্রিহিটিং করা যায়।

২. মূল কক্ষ – প্রিকুলিং চেম্বারে ৪৮-৭২ ঘণ্টা থাকার পর আলুর বস্তা এ কক্ষে সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে।

মূল কক্ষে আলু সংরক্ষণের দিন থেকে তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমিয়ে ১৫-২০ দিনের মধ্যে তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সে. থেকে ৩.৫ ডিগ্রি সে. এ নামিয়ে আনতে হবে ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৮৫%-৯০% বজায় রাখতে হবে।

আলু সংরক্ষণের ১৫-২০ দিন মেয়াদের মধ্যে প্রতিদিন অন্তত পক্ষে ৫/১০ মিনিট করে মুক্ত বাতাস হিমকক্ষগুলোতে সরবরাহের ব্যবস্থা করা দরকার।

পরবর্তীতে প্রথম ৩ মাস ৫ দিন অন্তর এবং মৌসুমের অবশিষ্ট সময়ে ৭ দিন অন্তর যথারীতি মুক্ত বাতাস সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বস্তাবন্দী আলু সমভাবে প্রবাহিত বাতাসের সংস্পর্শে আসার জন্য জুন মাসের মাঝামাঝি একবার ও আগস্টের শেষভাগে আরেকবার আলুর বস্তা উলটপালট করতে হবে।

নভেম্বর মাসে জমিতে লাগানোর উদ্দেশ্যে কোল্ডস্টোরেজের মূল কক্ষ হতে আলু প্রিহিটিং চেম্বারে ৪৮-৭২ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। এরপর বাসায় আলু বস্তা এনে বস্তা খুলে বীজ আলু ছায়াযুক্ত স্থানে ছড়িয়ে রাখতে হবে। কাঁটা, ফাটা এবং পচা আলু সরিয়ে ফেলে দিতে হবে।

কৃষকপর্যায়ে আলু সংরক্ষণ

বাংলাদেশে প্রায় ৪০০টি কোল্ডস্টোরেজ এ প্রায় ৬০ লাখ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ করা যায়। আবার কোল্ডস্টোরেজ এর পাঁচ ভাগের তিন ভাগ উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত ।

বিগত বছরগুলোতে দেখা যায় বাংলাদেশে মোট আলু উৎপাদনের প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগ হিমাগারে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়। বাকি আলু কৃষক সাধারণ অবস্থায় নিজেদের ঘরে রেখে দেন।

সাধারণ অবস্থায় সংরক্ষিত আলু ৪-৫ মাসের মধ্যেই খেয়ে শেষ করতে হবে অথবা অন্য উপায়ে ব্যবহার করতে হবে, যেমন-প্রক্রিয়াজাত করা যেতে পারে।

কারণ, সাধারণ অবস্থায় সংরক্ষিত আলু আস্তে আস্তে গুণাগুণ নষ্ট হয়ে খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে আলু এমনভাবে সংরক্ষণ করতে হবে যাতে পচে নষ্ট হওয়ার বিভিন্ন কারণগুলো যথাসম্ভব পরিহার করে চলা যায়।

স্বাভাবিক তাপমাত্রায় আলু সংরক্ষণের জন্য যে ঘরটি অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা, সহজেই বাতাস চলাচল করতে পারে এবং যেটি গাছের ছায়ায় অবস্থিত সেটিকে আলু সংরক্ষণের জন্য নির্বাচন করতে হবে।

তাছাড়া ঘরটি যদি পুকুরের পাড়ে হয় তবে তাতে সর্বদা বায়ু চলাচল থাকতে হবে নির্বাচিত ঘরটিতে যদি পূর্ববর্তী বছর আলু রাখা হয়ে থাকে তবে তা অবশ্যই ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে।

তারপর কীটনাশক ছিটিয়ে পোকামুক্ত করে নিতে হবে যাতে আগের বছরের কোন পোকা সংরক্ষিত আলুতে আক্রমণ করতে না পারে।

যদি এ বছরই নতুনভাবে সংরক্ষণ করা হয় তবে ঘরে মাচা বা তাক বানানো যেতে পারে। প্রথমে মাটি হতে এক ফুট উপরে একটি মাচা বানাতে হবে।

এক মাচা থেকে আর এক মাচা দূরত্ব ২.৫-৩.০ ফুট হলে সংরক্ষণ পরবর্তী বাছাই ও অন্যান্য কাজ সহজতর হয়।

শেষকথা, খাবার আলু, বীজ আলু ও রপ্তানিযোগ্য আলু সঠিক সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ করতে পারলে আলু অপচয় যেমন একদিকে রোধ হবে একই সাথে ভোক্তার টেবিলে গুণগত মানসম্পন্ন আলু পৌঁছে যাবে এবং আলু রপ্তানি বাণিজ্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে ।

কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য ও পরামর্শ, ফসলের চাষ পদ্ধতি, সার প্রয়োগ এবং ফসলের বিভিন্ন রোগ বালাই সম্পর্কে জানতে নিয়মিত ভিজিট করূন Krishakbd.com

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *