বিনাসয়াবিন চাষাবাদ পদ্ধতি

বাংলাদেশে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ফসলগুলোর মধ্যে বিনাসয়াবিন-৬ অন্যতম এবং এটি অত্যন্ত লাভজনক। তাই আসুন জেনে নিই বিনাসয়াবিন-৬ এর চাষাবাদ পদ্ধতি।

বিনাসয়াবিন

বারিসয়াবিন-৫ জাতের বীজে বিভিন্ন মাত্রায় গামারশ্মি (১৫০, ২০০, ২৫০, ৩০০ এবং ৩৫০ গ্রে) প্রয়োগ করে পরবর্তী প্রজন্মে একক গাছ নির্বাচন পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে ৩০০ গ্রে মাত্রা হতে উন্নত মিউট্যান্ট লাইন এসবিএম-২২ নির্বাচন করা হয়।

পরবর্তীতে ২০১৯ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক লাইনটিকে দেশের সয়াবিন চাষাধীন এলাকায় চাষাবাদের জন্য বিনাসয়াবিন-৬ নামে নিবন্ধন দেয়া হয়।

শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য

গাছ উচ্চতায় মাঝারি, পাতা অন্যান্য জাতের তুলনায় গাঢ় সবুজ এবং বীজের রঙ হালকা হলুদ ও অন্যান্য জাতের বীজের তুলনায় উজ্জ্বল।

জাতটি ভাইরাসজনিত হলুদ মোজাইক রোগ সহনশীল এবং পোকার আক্রমণ কম। তাছাড়া জাতটি মাঝারি মাত্রার লবণাক্ততা সহিষ্ণু।

অন্যান্য বৈশিষ্ট্য

গাছের উচ্চতা ৫৫-৬৩ সে.মি.; প্রাথমিক শাখার সংখ্যা ২-৪টি; প্রতি গাছে ফলের সংখ্যা ৪৬- ৬০টি; প্রতি ফলে বীজের সংখ্যা ২-৩টি; ১০০ বীজের ওজন ১১.০-১৩.৫ গ্রাম; জীবনকাল ১০৫-১১৫ দিন; গড় ফলন ২.৬০ টন/হে.; সর্বোচ্চ ফলন ৩.২০ টন/হে ।

বিনাসয়াবিন চাষে জমি নির্বাচন

এ দেশের মাটি এবং আবহাওয়ায় রবি ও খরিফ উভয় মৌসুমেই সয়াবিন চাষ করা যায়। বেলে দো-আঁশ হতে দো-আঁশ মাটি সয়াবিন চাষের জন্য বেশি উপযোগী।

খরিফ বা বর্ষা মৌসুমে চাষের জন্য নির্বাচিত জমি অবশ্যই উঁচু ও পানি নিষ্কাশনযোগ্য হতে হবে। রবি মৌসুমে মাঝারি থেকে নিচু জমিতে চাষ করা যায়।

নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চানপুর, ভোলা, যশোর, রংপুর এবং ময়মনসিংহ অঞ্চল জাতগুলো চাষের জন্য উপযোগী।

বিনাসয়াবিন চাষে জমি তৈরি

মাটির প্রকারভেদে ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে এবং আগাছামুক্ত করে বীজ বপন করতে হবে। মই দিয়ে জমি সমান করার পর সুবিধামতো আকারে প্লট তৈরি করে নিলে পরবর্তীতে সেচ প্রয়োগ, পানি নিষ্কাশন ও অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা করতে সুবিধা হয়।

বিনাসয়াবিন এর বীজ বপনের সময়

বাংলাদেশে রবি ও খরিফ-২ উভয় মৌসুমেই সয়াবিন চাষ করা যায়।

রবি মৌসুমে পৌষের প্রথম থেকে মাঘ মাসের মাঝামাঝি (ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারির শেষ) পর্যন্ত এবং খরিফ-২ মৌসুমে মধ্য আষাঢ় থেকে মধ্য ভাদ্র (জুলাইয়ের প্রথম থেকে আগস্টের শেষ) পর্যন্ত বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।

বীজ হার সারিতে বপনের ক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি ৫৫ কেজি (একরে ২২ কেজি) এবং ছিটিয়ে বপনের ক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি ৭০ কেজি (একরে ২৮ কেজি) বীজ প্রয়োজন।

বিনাসয়াবিন এর বীজ বপন পদ্ধতি

সয়াবিন বীজ সারিতে বপন করা উত্তম, তবে ছিটিয়েও বপন করা যায়। সারিতে বপন করলে সারি থেকে সারির দূরত্ব রবি মৌসুমে ৩০ সেমি. বা ১২ ইঞ্চি দিতে হবে।

সারিতে ১.০-২.০ ইঞ্চি গভীরে বীজ বপন করতে হয়। রবি মৌসুমে ছিটিয়ে বপন করলে চাষের পর বীজ ছিটিয়ে মই দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিতে হবে। খরিফ-২ মৌসুমে মাটি কাদাযুক্ত হলে বীজ অল্প গভীরতায় দিলেই গজাবে।

বিনাসয়াবিন চাষে সারের মাত্রা ও প্রয়োগ

বাংলাদেশে কৃষি পরিবেশ অঞ্চলভেদে সারের মাত্রা বিভিন্ন রকম হয়। ছকে সয়াবিন চাষের জন্য সাধারণভাবে অনুমোদিত সারের মাত্রা উল্লেখ করা হলো –

সারের নামসারের পরিমান (হেক্টর প্রতি)
ইউরিয়া৫০-৬০ কেজি
টিএসপি১৫০-১৭৫ কেজি
এমওপি১০০-১২০ কেজি
জিপসাম৮০-১১৫ কেজি
জিংক সালফেট৪-৬ কেজি
বরিক এসিড৮-১০ কেজি
জীবানুসার (ইউরিয়ার বদলে)২০-৩০ গ্রাম (প্রতি কেজি বীজের জন্য)

শেষ চাষের আগে সব রাসায়নিক সার ছিটিয়ে মই দিয়ে মাটি সমান করতে হবে। রাসায়নিক সারগুলোর সাথে পচা গোবর অথবা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করলে রাসায়নিক সার কম লাগবে।

রাসায়নিক সার শেষ চাষের আগে জমিতে ছিটিয়ে দিয়ে পরে মই দিয়ে মাটি সমান করতে হবে।

জীবাণুসার প্রয়োগ

সয়াবিন গাছ রাইজোবিয়াম ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে বাতাস থেকে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে গাছের শিকড়ে জমা করতে পারে। বপনের আগে বীজে জীবাণুসার মিশিয়ে বপন করলে গাছের শিকড়ে নডিউল বা গুটি সহজে সৃষ্টি হয়।

শিকড়ে সৃষ্ট এ গুটি থেকে গাছ নাইট্রোজেন পায়। উল্লেখ্য, জীবাণুসার প্রয়োগ করা হলে সাধারণত ইউরিয়া সার প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না।

জীবাণুসার ব্যবহার পদ্ধতি

একটি পাত্রে এক কেজি পরিমাণ বীজ নিয়ে পরিষ্কার পানিতে হাত ভিজিয়ে ভিজা হাতে সয়াবিন বীজ নাড়াচাড়া করতে হবে যাতে সকল বীজের উপরিভাগ ভিজে যায়।

এক কেজি সয়াবিন বীজে ২০-৩০ গ্রাম চিটাগুড় বা ভাতের ঠাণ্ডা মাড় ভালোভাবে মেশানোর পর ২০-৩০ গ্রাম জীবাণুসার মিশিয়ে ভালোভাবে নাড়াচাড়া করতে হবে যাতে চিটাগুড় মিশ্রিত আঠালো বীজের গায়ে জীবাণুসার সমভাবে লেগে যায়।

জীবাণুসার মেশানোর পর বীজ তাড়াতাড়ি বপন করতে হবে, কারণ জীবাণুসার পাউডার মেশানোর পর বীজ অনেকক্ষণ ফেলে রাখলে জীবাণুসারের গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়।

আস্তাপরিচযা

চারা গজানোর ১৫-২০ দিনের মধ্যে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। গাছ খুব ঘন হলে পাতলা করে দিতে হবে এবং সারিতে গাছ হতে গাছের দূরত্ব রাখতে হবে ২.০-৩.০ ইঞ্চি।

চারার বয়স ৩০-৩৫ দিন হওয়ার মধ্যেই নিড়ানি অথবা কোদাল দিয়ে কুপিয়ে আগাছা দমন বা গাছ খুব ঘন হলে পাতলা করে দিতে হবে।

রবি মৌসুমে গাছে ফুল ধরা এবং ফল বা শুঁটি ধরার সময় সম্পূরক সেচের প্রয়োজন হতে পারে। বৃষ্টি না হলে প্রথম সেচ বীজ গজানোর ২০ থেকে ৩০ দিন পর এবং দ্বিতীয় সেচ বীজ গজানোর ৫০-৫৫ দিন পর দিতে হবে।

খরিফ মৌসুমে সাধারণত এ ফসলের জন্য কোনো সেচের প্রয়োজন হয় না, বরং জমিতে পানি জমে গেলে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।

রোগবালাই দমন

১. বিছাপোকা –

ডিম থেকে ফোটার পর ছোট অবস্থায় বিছাপোকার কীড়াগুলো একস্থানে দলবদ্ধভাবে থাকে এবং পরবর্তীতে আক্রান্ত গাছের পাতা খেয়ে জালের মতো পাতা ঝাঁঝরা করে ফেলে।

এ পোকা দমনের জন্য আক্রান্ত পাতা পোকাসহ তুলে মেরে ফেলতে হবে । পাতা মোড়ানো পোকার কীড়া পাতা ভাঁজ করে ভিতরে অবস্থান করে এবং পাতার সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে।

উভয় পোকার আক্রমণ বেশি হলে সেভিন ৮৫ এসপি ৩৪ গ্রাম পাউডার প্রতি ১০ লিটার পানিতে অথবা এডভান্টেজ ২০ এসসি ৩০ মিলি. প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত গাছে স্প্রে করতে হবে।

২. কাণ্ডের মাছি পোকা

এ পোকার কীড়া কাণ্ড ছিদ্র করে ভিতরের নরম অংশ খেয়ে ফেলে, ফলে আক্রান্ত গাছ দ্রুত মরে যায়।

এ পোকা দমনের জন্য ডায়াজিনন ৬০ ইসি ২৫-৩০ মিলি, প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত জমিতে স্প্রে করতে হবে।

৩. কাণ্ড পচা রোগ

মাটিতে অবস্থানকারী ছত্রাকের কারণে এ রোগ হয়ে থাকে। আক্রান্ত গাছের পাতা হলুদ হয়ে যায় এবং কাণ্ড ও মূলে কালো দাগ দেখা যায় ।

আক্রান্ত চারা বা গাছ ধীরে ধীরে শুকিয়ে মরে যায়। গভীর চাষ এবং জমি হতে ফসলের পরিত্যক্ত অংশ, আগাছা ও আবর্জনা পরিষ্কার করে ফেলে এ রোগের উৎস নষ্ট করা যায়।

৪. হলুদ মোজাইক –

সয়াবিনের সবুজ পত্রফলকের উপরিভাগে উজ্জ্বল সোনালী বা হলুদ রঙের চক্রাকার দাগের উপস্থিতি এ রোগের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

সুস্থ এবং রোগমুক্ত বীজ বপনের মাধ্যমে এ রোগের আক্রমণ অনেকটা কমানো যায়। উল্লেখ্য যে, বিনাসয়াবিন-৬ হলুদ মোজাইক রোগ সহনশীল।

তবে সুস্থ এবং রোগমুক্ত বীজ বপনের মাধ্যমে এ রোগের আক্রমণ অনেকটা কমানো যায় ।

ফসল সংগ্রহ ও বীজ সংরক্ষণ

বিনাসয়াবিন-৬ বপন থেকে ফসল কাটা পর্যন্ত মৌসুমভেদে ১০২ থেকে ১১৫ দিন সময় লাগে। পরিপক্ব অবস্থায় সয়াবিন গাছ শুঁটিসহ হলুদ হয়ে এলে এবং পাতা বারে গেলে মাটির উপর হতে কেটে সংগ্রহ করতে হবে।

শুঁটিসহ সয়াবিন গাছ রোদে ৩-৪ দিন শুকিয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বীজ আলাদা করতে হবে। বীজ রোদে ভালো করে শুকিয়ে ঠাণ্ডা করে গুদামজাত করতে হবে।

উল্লেখ্য যে, সয়াবিনের অংকুরোদগম ক্ষমতা সাধারণ অবস্থায় বেশি দিন বজায় থাকে না। তাই সংরক্ষণের ২-৩ মাস পরই বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা কমতে শুরু করে।

তাই পরবর্তী মৌসুমে ব্যবহারের জন্য বীজ সংরক্ষণ করতে হলে নিম্নলিখিত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে –

  • মাড়াই করার পর বীজ বিশেষ যত্নসহকারে শুকাতে হবে। যদি রোদের উত্তাপ খুব প্রখর হয় তবে বীজ একটানা তিন থেকে চার ঘন্টার বেশি রোদে শুকানো ঠিক নয়।

কারণ কড়া রোদে অনেকক্ষণ ধরে বীজ শুকালে অংকুরোদগম ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় । তাই প্রতিদিন অল্প সময় করে অর্থাৎ দুই থেকে তিন ঘন্টা করে কয়েক দিন শুকাতে হবে।

শীতকালে যখন রোদের তাপ কম থাকে তখন একটানা চার থেকে পাঁচ ঘন্টা ধরে শুকালেও কোনো ক্ষতি হয় না।

সয়াবিন বীজ সরাসরি সিমেন্টের তৈরি পাকা খোলায় না শুকিয়ে ত্রিপল বা চাটাইয়ের উপর শুকাতে হবে । বীজ এমনভাবে শুকাতে হবে যাতে বীজের।

আর্দ্রতা ৯% এর বেশি না থাকে। শুকানো বীজ দাঁত দিয়ে কামড় দিলে ‘কট’ শব্দ করে বীজ ভেঙে গেলে বুঝতে হবে যে বীজ ভালোভাবে শুকিয়েছে।

  • শুকানোর পর বীজ ভালোভাবে ঝেড়ে পরিষ্কার করতে হবে এবং রোগাক্রান্ত পচা বীজ বেছে ফেলে দিতে হবে। 
  • বীজ সংরক্ষণের পূর্বে এর অংকুরোদগম ক্ষমতা পরীক্ষা করে নিতে হবে।
  • বীজ রাখার জন্য পলিথিনের ব্যাগ, প্লাস্টিক বা টিনের ড্রাম, আলকাতরা মাখা মাটির মটকা বা কলসি, বিস্কুটের টিন ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।

তবে মোটা পলিথিনের ব্যাগে বীজ রেখে মুখ শক্ত করে বেঁধে নিয়ে তা আবার একটি চটের বস্তায় ভরে রাখলে ভালো হয়।

পলিথিনের ব্যাগ, প্লাস্টিক বা ধাতব পাত্র যাই হোক না কেন প্রত্যেক ক্ষেত্রেই এর মুখ ভালোভাবে আটকিয়ে রাখতে হবে যেন কোনোভাবেই ভিতরে বাতাস ঢুকতে না পারে।

উল্লেখ্য, বীজ শুকানোর পর গরম অবস্থায় সংরক্ষণ না করে ঠাণ্ডা হলে সংরক্ষণ করতে হবে।

কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য ও পরামর্শ, ফসলের চাষ পদ্ধতি, সার প্রয়োগ এবং ফসলের বিভিন্ন রোগ বালাই সম্পর্কে জানতে নিয়মিত ভিজিট করূন Krishakbd.com

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *