কাজুবাদাম চাষ পদ্ধতি
কাজুবাদাম একটি সুস্বাদু ও দামী ফল তাই এটির যথাযথ চাষাবাদ ও রোগ-প্রতিরোধ সম্পর্কে জানা আমাদের প্রয়োজন
বৃক্ষ জাতীয় ফসলের আন্তর্জাতিক বানিজ্যে কাজুবাদামের স্থান তৃতীয়। এর বীজ থেকে পাওয়া বাদাম সুস্বাদু ও পুষ্টিকর এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়েও মূল্যবান। বাংলাদেশের জলবায়ু কাজুবাদাম চাষের জন্য বেশ সহায়ক। বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলে ব্যাপকভাবে কাজুবাদাম চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। আসুন আমরা কাজুবাদাম চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জেনে নিই।
জাত
বাংলাদেশে কোনো অনুমোদিত জাত নেই। তবে ফলের রঙের ভিত্তিতে লাল, হলুদ, গোলাপী জাত নামে বলা হয়। VLA-4, BPP-1, BPP-8, Vengurla-8, Ullal-1, BLA39-4, ভাষ্করা প্রভৃতি কাজু বাদামের উন্নত হাইব্রিড জাত যা আমাদের দেশে চাষ উপযোগী।
জলবায়ু
কাজুবাদাম উষ্ণমন্ডলীয় ফল। কষ্ট সহিষ্ণু ও খরা প্রতিরোধী। প্রখর সূর্যালোক পছন্দ করে এবং ছায়াতে তেমন বৃদ্ধি পায় না।তাপমাত্রা অধিক হলে কচি ফল ঝরে যায়।অধিক বৃষ্টিপাত এবং মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া ফলন কমিয়ে দেয়।
আরোও পড়ুন – https://krishakbd.com/cultivat-aloe-wood-or-wagle-wood/
মাটি
ভারী বেলে দো-আঁশ এবং লাল মাটির পাহাড়ি ঢালে এটি ভালো জন্মে। মাটির অম্লমান ৫-৬.৫০ গাছের বৃদ্ধিতে সহায়ক ভুমিকা রাখে।
কাজুবাদাম চাষ পদ্ধতি
বীজ থেকে চারা তৈরি
বীজ এবং জোড় কলমের মাধ্যমে এর বংশবিস্তার করা যায়। পাকা ফল গাছ থেকে ঝরে পড়লে সেখান থেকে বীজ সংগ্রহ করে ৩-৪ দিন রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। শুকনো বীজ ২৪-৩৬ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে অংকুরিত বীজ জুন মাসে বপন করলে অংকুরোদগম বেশী হয়।
কলমের চারা তৈরি
জুলাই-অক্টোবর মাস পর্যন্ত কলম করা যায়। ২-৬ মাসের চারাকে আদি জোড় হিসেবে নেয়া হয়। কাঙ্খিত গাছের সায়ন ফাটল জোর পদ্ধতিতে স্থাপন করে নতুন চারা তৈরি করা যায়।
রোপণ পদ্ধতি
- জুন-আগস্ট মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। কমবেশি ১ বছরের কলমের চারা লাগালে ভালো হয়।
- চতুর্ভুজী পদ্ধতিতে ৭-৮ মিটার দুরত্বে রোপণ করলে হেক্টরে কমবেশি ১৫০-১৮০ টি চারা প্রয়োজন। ত্রিভুজী পদ্ধতিতে পাহাড়ি ঢালে একই জায়গায় ১৫% বেশি চারা রোপণ সম্ভব।
- ঘন পদ্ধতিতে চারা রোপণ করলে রোপনের ৩-৪ বছর হতে গাছের অঙ্গছাঁটাই করতে হবে।
সার প্রয়োগ
মে-জুন মাসে একবার এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে দ্বিতীয় বার গাছের গোড়ায় রিং পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। বয়স ভেদে সারের চাহিদা ভিন্ন হয়।
১ বছর বয়সী গাছের গোড়ায় ২ বারে গোবর/জৈবসার ১০ কেজি, ইউরিয়া সার ২৫০ গ্রাম, টিএসপি ২০০ গ্রাম এবং পটাশ ১৫০ গ্রাম প্রয়োজন।
পরবর্তীতে ২য় বছরে ১ম বছরের দ্বিগুণ, ৩য় বছরে তিনগুণ, ৪র্থ বছরে চারগুণ এভাবে সারের মাত্রা বাড়াতে হবে। তবে কাঙ্ক্ষিত ফলনের জন্য গাছের চাহিদা মতো যুক্তিসংগত মাত্রায় সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
সেচ প্রদান
কাজুবাদামে তেমন সেচের প্রয়োজন হয় না। তবে গ্রীষ্মকালে ফল ধরার সময় একবার সেচ দিয়ে মালচিং করে দিলেই চলে।
ডালপালা ছাঁটাইকরণ
কলমের চারার ক্ষেত্রে জোড়া লাগা স্থানের নিচে গজানো সকল ডাল কেটে ফেলতে হবে। ৩-৪ বছরের মধ্যে ডালপালা কেটে গাছের উপযুক্ত কাঠামো তৈরি করতে হবে।
৪-৫ বছর পর মাটি থেকে ৪-৫ মিটার উপরে গাছের কাণ্ড কেটে দিতে হবে। তাছাড়া ঘন, রোগাক্রান্ত মরা ডাল ছাঁটাই করে দিতে হবে।
টপওয়ার্কিং করা
ফলন কমে গেছে এমন পুরোনো গাছ মাটি থেকে ১-২ মিটার উঁচুতে নভেম্বর-মার্চ মাসে কেটে দিতে হবে। নতুন গজানো শাখায় ফেব্রুয়ারী-জুন মাসে উন্নত জাতের সায়ন দিয়ে জোড় কলম করে ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
আরোও পড়ুন – ভুট্টা চাষ পদ্ধতি
রোগ বালায় দমন
- কাণ্ড ও মূল ছিদ্রকারী পোকা গাছের বেশি ক্ষতি করে থাকে। কার্বারাইল কীটনাশক ২ গ্রাম পরিমাণ ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে ছিদ্রের ভিতরে স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
- চায়ের মশক গান্ধী পোকা কচি পাতা, কাণ্ড, পুষ্পমঞ্জরি এবং কচি ফলের রস চুষে খায়। ডাইমেথয়েট/ক্লোরোপাইরিফস ০.০৫% হারে স্প্রে করলে পোকা দমন হয়।
- থ্রিপস পোকা পাতার নিচের অংশ কুরে কুরে খায়। দমনের জন্য কার্বারিল/মনক্রোটোফস ০.০৫% হারে স্প্রে করা যায়।
- ফল ও বাদাম ছিদ্রকারী পোকা দমনের জন্য মনোক্রোটোফস ০.০৫% হারে স্প্রে করা যায়।
- পাওডারি মিলডিউ/ডাইব্যাক/এনথ্রাকনোজ রোগে রোগাক্রান্ত পাতা,ডাল,শাখা-প্রশাখা কেটে পুড়ে ফেলতে হবে। ১% বর্দোমিক্সার, ডাইথেন এম-৪৫ প্রভৃতি রোগনাশক প্রয়োগ করলে রোগের প্রকোপ কমানো যায়।
ফল সংগ্রহ ও ফলন
বীজের গাছে ৩-৪ বছর পর এবং কলমের গাছে পরের বছর ফল ধরে। ১০ বছর গাছে পূর্ণ ফলন পাওয়া যায় এবং ২০-২৫ বছর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে।
নভেম্বর-জানুয়ারি মাসে ফুল ফোটে এবং মার্চ-মে মাসে ফল পাকে। পরিপক্ব ফল সংগ্রহ পরবর্তী বাদাম আলগা করে ৩-৪ দিন রোদে শুকিয়ে বীজে ৯-১০% আর্দ্রতা থাকে এমন অবস্থায় সংরক্ষণ করা হয়।
১০ বছর একটি গাছে গড়ে ৭-৮ কেজি বাদাম হয়। তবে হাইব্রিড জাতের গাছ ও পরিচর্যা ভালো হলে ১৫-১৬ কেজি পর্যন্ত ফলন হতে পারে।
আরোও পড়তে পারেন – মিষ্টি আলু চাষ পদ্ধতি
পাহাড়ি অঞ্চলে কাজুবাদাম উন্নয়নের সম্ভাবনা
পাহাড়ি এলাকায় নভেম্বর থেকে প্রায় এপ্রিল-মে মাস পর্যন্ত কোনো বৃষ্টিপাত হয় না। অর্থাৎ ৫-৬ মাস পাহাড়ি ভুমি বৃষ্টিহীন অবস্থায় থাকে। আবার সেখানে সেচ দেওয়ার তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই।
মার্চ এপ্রিল মাসে প্রচন্ড খরা এবং গরম হাওয়া বিদ্যমান থাকে। সেই অবস্থায়ও কাজুবাদাম বেশ ভালো ফলন দিয়ে থাকে।
সামান্য পরিচর্যা করা হলে এক হেক্টর থেকে ১.৫-১.৮ টন কাজুবাদাম পাওয়া সম্ভব।