বারোমাস আয় পেতে সঠিক নিয়েমে করুন কলা চাষ | উত্তম পদ্ধতির কলা চাষ

কলা একটি বারো মাসী ফল এবং বহু পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। জানুন কলা চাষের সঠিক পদ্ধতি ও কলার বিভিন্ন রোগবালাই নিয়ে বিস্তারিত

কাঁচা কলার উপকারিতা

কলা বাংলাদেশের সব জেলায়ই কম-বেশি জন্মে এবং বারোমাসই কলার প্রচুর চাহিদা থাকে। কারণ, বিশেষজ্ঞদের মতে, কলার মধ্যে রয়েছে প্রায় সব ধরণের পুষ্টি উপাদান। আর কলা কাঁচা ও পাকা দুই অবস্থায় খাওয়া যায়। তবে কলা চাষের সঠিক পদ্ধতি না জানলে বারোমাস কলা চাষ করে তেমন কোনো আয় করা সম্ভব হবে না। তাই কলা চাষের সঠিক পদ্ধতি জেনে কলা চাষ করা দরকার। এতে কলার ফলন খুবই ভালো হবে এবং বাজারে কলার ভালো দাম পাওয়া যাবে। আসুন জেনে নিই কলা চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে।

আরোও পড়ুন – কমলা চাষ পদ্ধতি

কলার জাত নির্বাচন

বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য বাংলাদেশে যেসব কলার জাত চাষ করা হয় সেগুলো হচ্ছে অমৃতসাগর, সবরি, চাপা,  মেহেরসাগর,কবরী  ইত্যাদি।

এছাড়াও কলার আরও অনেক উন্নত জাত আছে। যেমন – এঁটে কলা,বাঙলা কলা, জাহাজি কলা, কাচঁকলা বা আনাজি কলা ইত্যাদি। তবে বারি কলা-১, বারিকলা-২ ও বারিকলা-৩ নামে তিনটি উন্নত জাত চাষের জন্য অবমুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে বারিকলা-২ জাতটি কাচঁকলার।

কলার উৎপাদন প্রযুক্তি 

কালার উৎপাদন প্রযুক্তিগুলো হচ্ছে মাটি ও জমি তৈরি, রোপনের সময় ও চারা রোপণ, সার প্রয়োগ পদ্ধতি, অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা ইত্যাদি।

আরোও পড়তে পারেন – ড্রাগন ফল চাষ পদ্ধতি

কলা গাছ চাষ পদ্ধতি

কলা চাষের জন্য মাটি ও জমি তৈরি 

উর্বর দোআঁশ মাটি কলা চাষের জন্য ভালো। আর কলা চষের জন্য এমন জমি নির্বাচন করতে হবে যে জমিতে প্রচুর সূর্যের আলো পড়বে এবং পানি নিকাশের ব্যবস্থা থাকবে।

কলা চাষের জন্য গভীরভাবে জমি চাষ করে ২ মিটার দূরে দূরে ৫০ সেন্টিমিটার x ৫০সেন্টিমিটার x ৫০ সেন্টিমিটার আকারের গর্ত খুঁড়তে হবে। কলার চারা রোপণের প্রায় এক মাস আগে গর্ত করে গর্তে গোবর ও টিএসপি সার মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত পূর্ণ করতে হবে। 

কলার চারা রোপণের সময়

বছরে তিন মৌসুমে কলার চাষ করা হয় বা কলার চারা রোপণ করা হয়।

  • আশ্বিন – কার্তিক
  • মাঘ- ফাল্গুন
  • চৈত্র – বৈশাখ

আরোও জানতে পারেন – সঠিক নিয়মে রামবুটান চাষ করে আয় করুন লক্ষ টাকা

কলা গাছের চারা নির্বাচন

কলার চারাকে তেউড় বলা হয়। দুই রকমের তেউড় দেখা যায়।

১) অসি তেউড়

কলা চাষের জন্য অসি তেউড় উত্তম। অসি তেউড়ের পাতা সরু,সুচালো এবং অনেকটা তলোয়ারের মতো। গোড়ার দিকে মোটা এবং ক্রমশ উপরের দিগকে সরু হতে থাকে।

২)  পানি তেউড়

পানি তেউড় দুর্বল। এর আগা-গোড়া সমান থাকে। কলা চাষের জন্য এই চারা উপযুক্ত নয়। এ দুই ধরনের চারা ছাড়াও সম্পূর্ণ মূলগ্রন্থি বা তার ক্ষুদ্র অংশ থেকেও কলাগাছের বংশবিস্তার সম্ভব।

তবে এতে ফল আসতে কিছু বেশি সময় লাগে। ফলন্ত ও অফলন্ত দুই ধরনের গাছের মূলগ্রন্থি চারা হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। 

কলা গাছের চারা রোপণ পদ্ধতি

কলার চারা রোপণের জন্য প্রথমত অসি তেউড় বা তলোয়ার তেউড় নির্বাচন করতে হবে। খাটো জাতের ৩৫-৪৫ সেন্টিমিটার আর লম্বা  জাতের ৫০-৬০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের তেউড় ব্যবহার করা হয়।

আরোও পড়ুন – বারোমাসি আম চাষ

অতঃপর নির্দিষ্ট গর্তে যাতে প্রয়োজনীয় গোবর ও  টিএসপি সার দিয়ে পূর্ণ করা হয়েছে সেখানে চারা লাগাতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন চারার কান্ড মাটির ভিতরে না ঢুকে। 

কলা গাছ চাষে সার প্রয়োগ পদ্ধতি 

কলা গাছে ব্যবহৃত সারের নাম ও গাছ প্রতি সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো 

সারের নামগাছ প্রতি পরিমান 
ইউরিয়া৫০০-৬৫০ গ্রাম
টিএসপি২৫০-৪০০ গ্রাম
এমওপি২৫০-৩০০ গ্রাম
গোবর১৫-২০ গ্রাম

কলা গাছে সার প্রয়োগ করার সময়

কলার চারা রোপণের একমাস  পূর্বে গর্ত করে গোবর / আবর্জনা সার ও ৫০%  টিএসপি মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। রোপণের ২ মাস পর বাকি ৫০%  টিএসপি, ৫০%  এমওপি ও ২৫%  ইউরিয়া গাছের গোড়ার  চারদিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এর ২ মাস পর বাকি ৫০% এমওপি ও ৫০%  ইউরিয়া ফুল আসার সময় বাকি ২৫% ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে।

কলা চাষে সেচ

কলা গাছ চাষে সেচ ও নিকাশ

কলার জমিতে আদ্রতা না থাকলে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে১৫-২০ দিন পর পর সেচ দেওয়া দরকার।

বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি নিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় নালা কেটে দিতে হবে। কারণ কলাগাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না।

অতিরিক্ত কলার চারা কাটা

কলা গাছে ফুল বা মোচা আসার পূর্ব পর্যন্ত গাছের গোড়ায় যে তেউড় জন্মাবে তা কেটে ফেলতে হবে। মোচা আসার পর গাছ প্রতি ১টি তেউড় রাখা ভালো।

কলা গাছে খুঁটি দেওয়া 

কলাগাছে ছড়া আসার পর বাতাসে গাছ ভেঙে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাঁশ গাছের ডাল দিয়ে খুঁটি বেঁধে দিতে হবে।

আরোও পড়তে পারেন – লেবু চাষ পদ্ধতি

কলা গাছের রোগ ব্যবস্থাপনা

কলা গাছ ফল ও পাতার বিটল পোকা, রাইজোম উইভিল, থ্রিপস এসব পোকা দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। ডায়াজিনন ৬০ ইসি পানির সাথে মিশিয়ে স্প্রে করে এ পোকা দমন করা যায়। কলা চাষের সময় প্রধানত ৩ টি রোগের আক্রমণ দেখা যায়। সেগুলো হলোঃ-

১. কলা গাছে পানামা রোগ

এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। যার আক্রমণে কলা গাছের পাতা হলদে হয়ে যায়। পাতা বোঁটার কাছে ভেঙ্গে ঝুলে যায় এবং কান্ড অনেক সময় ফেটে যায়। আক্রান্ত গাছ মরে যায় অথবা ফুল-ফল ধরে না।

কলা গাছে এই পানামা রোগের প্রতিকার হিসাবে রোগমুক্ত গাছ লাগাতে হবে,  রোগক্রান্ত তুলে ফেলে দিতে হবে এবং প্রতিরোধী রোপণ করতে হবে। এছাড়া টিল্ট-২৫০ ইসি ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় আক্রান্ত কলা গাছে প্রয়োগ করলে সুফল পাওয়া যাবে।

২. কলা গাছে সিগাটোগা রোগ

এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এ রোগের আক্রমণে কলা গাছের পাতার উপর গোলাকার বা ডিম্বাকৃতির গাঢ় বাদামি রং এর দাগ পড়ে। আক্রমণ ব্যাপক হলে কলা গাছের পাতা ঝলসে যায় ও সমস্ত পাতা আগুনে পোড়ার মতো দেখায়। ছোট হয় এবং ফলন কম হয়। এই রোগের প্রতিকার হিসাবে আক্রান্ত কলা গাছের পাতা কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

৩. কলা গাছে গুচ্ছ মাথা রোগ

 পেটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ। জাব পোকার মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। ম্যালাথিয়ন বা অন্য যেকোনো অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগে জাব পোকা দমন করে এ রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

কলা গাছ থেকে ফসল সংগ্রহ

  1. কলার চারা রোপণের পর ১১-১৫ মাসের মধ্যে সব জাতের কলা সংগ্রহের উপযুক্ত হয়।
  2. ধারালো দা দিয়ে কলার ছড়া কাটতে হবে।

কলার ফলন

ভালোভাবে কলার চাষ করলে গাছ প্রতি প্রায় ২০ কেজি বা প্রতি হেক্টরে প্রায় ২০-৪০ টন কলা উৎপাদিত হবে।

FAQs

কলা চাষ কিভাবে করতে হয়?

সেচ ব্যবস্থা যুক্ত যেকোনো ধরনের মাটিতে কলা চাষ করা যায়। তবে কলা চাষ করতে হয় আদর্শ মাটি হিসাবে জৈব পদার্থ যুক্ত বেলে-দোঁয়াশ মাটিতে।

কলা কত দিনে পরিপক্ক হয়?

কলা রোপণের ১১-১৫ মাসে মধ্যেই প্রায় সব জাতের কলা পরিপক্ব হয়।

কলা কি বীজ থেকে জন্মায়?

সাধারণত কলা গাছ বীজ থেকে জন্মায় না। কলা গাছ কাটার পর গোড়ার যে অংশ রাখা হয় তা থেকে আবার কলা গাছ জন্মায়। তবে বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে কলা চাষ করার জন্য বীজ থেকে কলা চাষ করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে।

সবুজ কলা পাকতে কত সময় লাগে?

সবুজ কলা পাকাতে ২৪ ঘন্টা থেকে ৪ বা ৫ দিন সময় লাগে।

কলা খেলে কি ওজন কমে?

না কলা খেলে ওজন কমে না।

প্রতিদিন কলা খাওয়া কি ভালো?

প্রতিদিন ১/২ টা কলা খাওয়া ভালো।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *