আখ চাষ পদ্ধতি ও আখের উপকারিতা
আখ একটি পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ফসল। এই আখের চাহিদা বাজারে প্রচুর। কিন্তু সে পরিমান আখের উৎপাদন নেই। তাই বর্তমানে ব্যাপকভাবে আখের চাষ হচ্ছে। তাই আসুন আখ চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানি।
আমাদের দেশের জন্য আখ বা ইক্ষু একটি জনপ্রিয় অর্থকারি ফসল। আখের ইংরেজি হলো Sugarcane এবং ইক্ষু বা আখের বৈজ্ঞানিক নাম হলো Saccharum. আমারা সবাই জানি আখ চিনি উৎপাদনের মূল ফসল এবং আখের উপকারিতা অপরিসীম। তাই, আখের চাহিদা প্রচুর, কিন্তু সে তুলনায় আমাদের দেশে আখ উৎপাদন অনেক কম। তবে বর্তমানে চিনির দাম বাড়ায় কৃষকরা এই ইক্ষু বা আখ চাষে মনযোগী হচ্ছেন এবং আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। তাই চলুন আখ চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জেনে নিই।
আরোও পড়তে পারেন – সজিনা চাষ পদ্ধতি
আখ চাষের জমি ও মাটি নির্বাচন
প্রায় সব ধরনের জমিতে বা মাটিতে আখের চাষ করা গেলেও আখ চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি এবং এঁটেল, দোআঁশ ও এঁটেল-দোআঁশ মাটি নির্বাচন করতে হবে। আখ চাষের জন্য এমন জমি নির্বাচন করতে হবে যে জমিতে পানি জমে থাকে না এবং আখ উৎপাদনের জন্য পানি নিকাশের সুব্যবস্থা থাকবে।
আখ চাষের পূর্বে আখের জাত নির্বাচন
আমাদের দেশে আখের বিভিন্ন জাত রয়েছে। তবে আমাদের উচ্চ-ফলনশীল জাতের আখ নির্বাচন করতে হবে। আর এসব আখের জাতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঈশ্বরদী ২/৫৪, ঈশ্বরদী ১৬, ২০, ৩২-৪০, বিএসআর আই আখ ৪১-৪৪ অমৃত ইত্যাদি।
আখ চাষের পূর্বে জমি তৈরী
আখ হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি, লম্বা ও ঘন শিকড় যুক্ত ফসল। তাই আখ চাষের আগে আখের জমিতে মই দিয়ে ভালোভাবে গভীর করে ৫/৬টি চাষ দিয়ে জমি তৈরী করতে হবে। আর ইক্ষুর উৎপাদন ভালো হওয়ার জন্র জমি তৈরীর সময় জমিতে একরপ্রতি ৪ টন গোবর বা আর্বজনা সার দিতে হবে।
আখ রোপণের সময়
অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত আখের চারা আখ চাষের জমিতে রোপণ করা যায়। তবে আখের চারা জমিতে রোপণের সর্বোত্তম সময় হলো মধ্য সেপ্টেম্বর মাস থেকে নভেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত।
আরোও পড়ুন – করমচা চাষ পদ্ধতি
আখ চাষে সার প্রয়োগ
প্রতি হেক্টর জমিতে আখ রোপনের পর বিভিন্ন সার প্রয়োগ করতে হয়। আখ চাষের জমিতে সেই সার প্রয়োগের পরিমাণ নিম্নরূপ:
সারের নাম | পরিমাণ (হেক্টর প্রতি) |
ইউরিয়া | ১২০-১৫০ কেজি |
টিএসপি | ৮০-১১০ কেজি |
এমওপি | ১১০-১৪০ কেজি |
জিপসাম | ৫০-৬০ কেজি |
জিংক সালফেট | ১০-১৫ কেজি |
ডলোচুন | ১০০-১৫০ কেজি |
জৈব সার | ৫-৬ টন |
আখ চাষের জমি তৈরীর সময় ইউরিয়া সার ও এমওপি সার ছাড়া অন্যান্য সার জমিতে শেষ চাষের সময় মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর অর্ধেক ইউরিয়া ও এমওপি সার আখ চাষের রোপা পদ্ধতিতে রোপণ নালায় দিতে হবে এবং বাকী অর্ধেক ইউরিয়া ও এমওপি সার জমিতে আখের চারা রোপণের পর আখের কুঁশি গজানো পর্যায়ে বা ১২০ থেকে ১৫০ দিন পর উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
আরোও জানতে পারেন – লবণ চাষ পদ্ধতি
আখ চাষ বা রোপণ পদ্ধতি
আমাদের দেশে সাধরণত দুইভাবে আখ রোপণ করা হয়ে থাকে। যথা: ১) সনাতন পদ্ধতিতে আখ রোপণ ও ২) রোপা পদ্ধতিতে আখ রোপণ। নিম্নে ২ পদ্ধতিতে আখ চাষ বা রোপনের নিয়ম দেওয়া হলোঃ
১) সনাতন পদ্ধতিতে আখ চাষের জমিতে আখ রোপণ
- এই সনাতন পদ্ধতিতে আখের বীজ সংগ্রহ করে সেই বীজ শোধন করতে হয়।
- আর এই পদ্ধতিতে হেক্টর প্রতি হেক্টরে ৩০-৩৫ হাজার আখের বীজের প্রয়োজন হয়।
- আখের বীজখণ্ডগুলো সরাসরি মূল আখ চাষের জমিতে রোপণ করতে হয় নির্দিষ্ট দুরুত্ব অনুযায়ী সারি সারি করে।
- আখ চাষের জমি ভালোভাবে তৈরি করার পর কোদাল বা লাঙ্গল দিয়ে নালা তৈরী করতে হবে।
- সেই আখ চাষের জমির নালার ভিতর বেসালডোজ সার ছিটিয়ে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে জমির মাটির সাথে আখের বীজ ভালোভাবে মিশিয়ে দিয়ে দুই বা তিন চোখবিশিষ্ট বীজখণ্ড তৈরী করতে হবে।
- তারপর সেই বীজখন্ডের উপর প্রায় ২ ইঞ্চি মাটির আবরণ দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
- এরপর বীজ খণ্ডগুলোকে নালায় এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যেন আখের বীজখন্ডের চোখগুলো দুই পাশে থাকে।
- আখ চাসের জমির মাটিতে জো বেশি থাকলে বা আখের বীজের আগাম রোপণ করলে বীজখণ্ডের ওপর মাটি কম দিতে হবে এবং আখ চাসের জমির মাটিতে জো কম থাকলে বা শীতের সময় আখের চাষ করলে বীজখণ্ডের ওপর মাটি বেশি পরিমাণে দিতে হবে।
রোপা পদ্ধতিতে আখ রোপণ
- এই রোপা পদ্ধতিতে আখ চাষ করলে বীজতলায় আখের চারা তৈরি করে চারাগুলো মূল আখ চাষের জমিতে নালার ভিতর রোপণ করতে হবে।
- আর এই আখের চারা তৈরির জন্য বেশ কয়েকটি আখের চারা তৈরী পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। যেমন: পলিব্যাগে আখের চারা তৈরি, বীজতলায় আখের চারা তৈরি প্রভৃতি।
- আখের চারা তৈরির জন্য আখের বীজখণ্ডগুলো বিশেষ যত্নের সাথে তৈরি করতে হবে।
- বীজতলায় উৎপাদিত আখের চারাগুলো আখ চাষের জমির নালাতে ধান রোপন করার মতো রোপন করতে হবে।
আরোও জানুন – নেপিয়ার ঘাস চাষ পদ্ধতি
আখ চাষের ক্ষেত্রে পরিচর্যা
- আখ চাষের জমিতে আখগাছ বড় হলে যাতে হেলে পড়ে না যায় সেজন্য কয়েকটি আখ গাছ একসাথে মিলিয়ে বেঁধে দিতে হবে।
- সাধারণত আখের শুকনা পাতাগুলো ঝরে পড়ে না। তাই, আখ গাছের শুকনা পাতাগুলো ছিঁড়ে কেটে ফেলতে হবে।
- আখ চাষের জমির মাটিতে বাতাস চলাচলের জন্য মাঝেরমধ্যে মাটি আলগা করে দিতে হবে।
- নিয়মিত আখ চাষের জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
- আখ দীর্ঘজীবি ফসল বিধায় আখ চাষের জমিতে প্রয়োজন অনুসারে সেচ দিতে হবে।
আখ চাষে পোকামাকড় ও রোগ-বালাই দমন ব্যবস্থাপনা
আখের মাজরা পোকা দমন
আখের ডগায় অনেক সময় মাজরা পোকা আক্রমণ করে। আর এই মাজরা পোকা দমনের জন্য কার্বোফুরান জাতীয় কীটনাশক ফুরাডান ৫ জি কিংবা কুরাটার ৫ জি অনুমোদিত মাত্রায় আখ গাছে প্রয়োগ করতে হবে।
আর আখের কান্ডে মাজরা পোকা আক্রমণ করলে সেই পোকা দমনের জন্য কারটাপ গ্রুপের রাজেক্স ৪ জি আক গাছে প্রয়োগ করতে হবে এবং আকের গোড়ার মাজরা পোকা আক্রমণ করলে সেটি দমনের জন্য ক্লোরোপাইরিফস গ্রুপের লরসবান ১৫ জি প্রয়োগ করতে হবে।
আরোও জানুন – সবচেয়ে লাভজনক ফল চাষ
আখের উঁইপোকা দমন
আখ গাছে উঁইপোকা দমনের জন্য ক্লোরোপাইরিফস গ্রুপের ডারসবান জাতীয় কীটনাশক নিয়ম অনুসারে প্রয়োগ করতে হবে।
আখের লাল পঁচা রোগ নিরাময়
আখের লাল পঁচা রোগ নিরাময়ের জন্য আখের বীজ গরম পানিতে অথবা ব্যাভিস্টিন নামক ছত্রাকনাশক দ্বারা ৩০ মিনিট শোধন করতে হবে।
আখের ফলন সংগ্রহ
ভালোভাবে আখের ক্ষেতের পরিচর্চা করলে হেক্টর প্রতি জমিতে আখের গড় ফলন হয় ৪০-৬৫ টন। আখ পরিপক্ক হলে জমি থেকে আখের গোড়া সহ নিতে হবে।
আখের উপকারিতা
আখের উপকারিতা হলো এতে থাকা ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন এবং ম্যাগনেসিয়াম আমাদের শরীরকে ক্যান্সার থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও নিয়মিত আখের রস বা আখ খেলে এটি আমাদের শরীরে প্রাকৃতিক শর্করা সরবরাহ করে এবং শরীর থেকে খারাপ কোলেস্টেরল কমিয়ে আমাদের ওজন কমাতে সহায্য করে। এছাড়াও আখের রসের উপকারিতা হলো এটি প্রেগন্যান্সি জনিত সমস্যা দূর করে, অঙ্গের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং কিডনির সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে।
আরোও জানুত পারেন – আতা ফল চাষ পদ্ধতি ও রোগবালাই
কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য ও পরামর্শ, ফসলের চাষ পদ্ধতি, সার প্রয়োগ এবং ফসলের বিভিন্ন রোগ বালাই সম্পর্কে জানতে নিয়মিত ভিজিট করূন Krishakbd.com
FAQs
আখ চাষের জমি থেকে মূল আখ কাটার পর মটিতে আখের যে গোড়া থাকে এবং সেই গোড় থেকে যে আখের সৃষ্টি হয় তাকে মুড়ি আখ বলে।
সাথি ফসল হিসেবে আখের সাথে ডাল, মসলা ও তেল জাতীয় ফসল (যেমনঃ মটরশুঁটি, ছোলা, মশুর, মুগ, পেঁয়াজ, রসুন, তিল, তিসি, সরিষা, বাদাম ইত্যাদি) চাষ করা যায়।
আখ ১২-১৫ মাস বা ৩৬০-৪০০ দিনের ফসল। অর্থাৎ আখ পরিপক্ক হতে প্রায় ১২-১৫ মাস সময় লাগে।
আখ উৎপাদনে শীর্ষ দেশ হলো ভারত, চীন, থাইল্যান্ড এবং ব্রাজিল।
১ টন আখ থেকে থেকে প্রায় আনুমানিক ১২০ কেজি চিনি, ৩৮ কেজি গুড়, ৩৬ কেজি ফিল্টার কাদা, ২৫০ কেজি ব্যাগাস, ৬০ কেজি খড় এবং ১০০ কেজি টপস উৎপন্ন হয়।
অক্টোবর-ডিসেম্বর মাসে আখ লাগানো ভালো আখের ভালো ফলন হয়।
এখর ভালো ফলন পেতে আখের বীজ শোধন করতে হয়।
একটি বড় আখের দাম হলো ৫০–৬০ টাকা, মাঝারি আখের দাম হলো ২৫–৩০ টাকা এবং প্রতি পিস আখের দাম সাইজ অনুযায়ী ৫-১০ টাকা।