সঠিকভাবে গ্লাডিওলাস ফুল চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা
আমাদের দেশে বর্তমানে গ্লাডিওলাস ফুলের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাই এই ফুল চাষ করে লাববান হওয়া সম্ভব। তাই চলুন জেনে নিই গ্লাডিওলাস ফুলের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে।
প্রচলিত অন্যান্য ফুলের মতো প্রতিনিয়ত আমাদের দেশে এই গ্লাডিওলাস ফুলের যথেষ্ট জনপ্রিয়তা ও চাহিদা বাড়ছে। আর এর একমাত্র কারণ হলো এই ফুল দীর্যসময় সজীব থাকে এবং এই গ্লাডিওলাস ফুলের রং ও গঠর খুবই আকর্ষনীয়।
তাই বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় যেমনঃ যশোর, সাতক্ষীরা, গাজীপুর এবং সাভার অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে এই গ্লাডিওলাস ফুলের চাষ হচ্ছে এবং কৃষকরাও অধিক লাভবান হচ্ছেন। তাই চলুন জেনে আসি গ্লাডিওলাস ফুলের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে।
আরোও পড়তে পারেন – রজনীগন্ধা ফুল চাষ পদ্ধতি
গ্লাডিওলাস ফুলের বিভিন্ন জাত
গ্লাডিওলাস ফুলের অনেক জাত রয়েছে। আর এই গ্লাডিওলাস ফুলগুলোকে বৃহদাকার, বড় ফুল, ক্ষুদ্র ফুল এবং প্রজাপতি ইত্যাদি নামে শ্রেণীবিন্যাস করা হয়ে থাকে। এই গ্লাডিওলাস ফুলের জাতগুলিকে আগাম, মাঝারি ও নাবী জাতে বিভক্ত করা যায়।
এছাড়াও এই গ্লাডিওলাস ফুলের মধ্যে সিঙ্গেল ও ডাবল জাতও বিদ্যমান। জাতভেদে গ্লাডিওলাস ফুল বিভিন্ন রংয়ের হয়ে থাকে, যেমনঃ-সাদা, হলুদ, গোলাপী, ফিকে লাল, লাল, গাঢ় লাল, কমলা, বেগুনী ইত্যাদি।
তবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট গ্লাডিওলাস ফুলের কয়েকটি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। আর সেগুলো হলোঃ-
বারি গ্লাডিওলাস-১ জাতঃ
এই গ্লাডিওলাস ফুলের জাতের বোঁটা বেশ লম্বা ও বেশি ফ্লোরেটযুক্ত। এই ফুলের লাল রঙের দুটি পাঁপড়িতে হলুদ ছোঁপ থাকে। সাধারণত পানিতে এই গ্লাডিওলাস ফুলের স্থায়িত্বকাল ৮ থেকে ৯ দিন।
বারি গ্লাডিওলাস-২ জাতঃ
এই গ্লাডিওলাস ফুলের জাত লম্বা বোঁটাসম্পন্ন এবং এই ফুলের পাপড়িতে গাঢ় মেজেন্টা রঙের অনেকগুলো ফ্লোরেট থাকে। আর প্রতি ফ্লোরেটের দুটি পাঁপড়িতে ক্রিম রঙের ছোপ দেখা যায় এবং অন্যান্য পাঁপড়িতে সাদা স্ট্রাইপ থাকে। সাধারণত এই ফুল পানিতে ৯ থেকে ১০ দিন সতেজ থাকে।
বারি গ্লাডিওলাস-৩ জাতঃ
এই গ্লাডিওলাস ফুল সারা বছর চাষ করা যায়। আর বাজারেও এই গ্লাডিওলাস ফুলের খুব চাহিদা আছে। তাই ক্রষকদের এই ফুল চাষ করা উচিৎ। এই বারি গ্লাডিওলাস-৩ জাতের গাছের পাতা তরবারির মতো। আর এই গ্লাডিওলাস ফুলের বীজ বা কর্ম রোপণের উপযুক্ত সময় হলো মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য নভেম্বর মাস।
এই ফুলের রঙ সাদা হয়। এই গ্লাডিওলাস ফুলের ফলন হলো প্রতি হেক্টর জমিতে ১.৭৫ থেকে ২.০০ লক্ষ ফুলের স্টিক। আর বারি গ্লাডিওলাস-৩ জাতের ফুলের সজীবতা ৮ থেকে ৯ দিন পর্যন্ত থাকে।
আরোও পড়ুন – অর্কিড ফুল চাষ পদ্ধতি
গ্লাডিওলাস ফুল চাষের জমি ও মাটি নির্বাচন
গ্লাডিওলাস ফুল চাষের জন্য জৈব সার সমৃদ্ধ বেলে দো-আঁশ অথবা দো-আঁশ মাটি খুবই উপযোগী। আর এই ফুল চাষের জন্য উঁচু জমি নির্ধারণ করতে হবে যাতে বৃষ্টি অথবা সেচের পানি জমে থাকে না।
তবে অধিক কাদাযুক্ত এবং কালো মাটির জমিতে এই গ্লাডিওলাস ফুল চাষ না করাই উচিৎ। যদি এই ফুল চাষের জমির মাটি হালকা হয় সেক্ষেত্রে জৈবসার মিশিয়ে মাটির গুণাগুন ভাল করতে হবে।
আর একই জমিতে বারবার গ্লাডিওলাস ফুল চাষ করলে মাটি বাহিত রোগের পরিমাণ বেড়ে যায়। তাই সেই জমিতে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ফসলও চাষ করতে হবে, এত মাটিও উর্বর হবে।
আরোও জানতে পারেন – টবে সূর্যমুখী ফুল চাষ পদ্ধতি
গ্লাডিওলাস ফুল চাষের আবহাওয়া
গ্লাডিওলাস ফুল চাষের জন্য আর্দ্র, রৌদ্র-উজ্জল ও নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া খুবই উপযোগী। এই গাছ উচ্চ তাপমাত্রা ও প্রখর রোদ সহ্য করতে পারেনা। তাই এই গ্লাডিওলাস ফুল চাষের ক্ষেত্রে একটু শীতল, ছায়াযুক্ত ও ঠান্ডা আবহাওয়া সম্পন্ন স্থান নির্বাচন করতে হবে। তবে অতিরিক্ত ছায়াযুক্ত স্থানেও এই ফুলের উৎপাদন ভালো হয় না।
আরোও জানতে পারেন – টবে ফুল চাষ পদ্ধতি
গ্লাডিওলাস ফুল চাষের সময়
এই গ্লাডিওলাস ফুল চাষের উপর্যুক্ত সময় হলো অক্টোবর মাস থেকে নবেম্বর মাস। কারণ, এই সময় রোদের প্রখরতা ও আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ অবস্থায় থাকে। আর তাই এই ফুলের ফলনও ভালো হয়।
গ্লাডিওলাস ফুল চাষের পূর্বে জমি চাষ বা জমি তৈরী
গ্লাডিওলাস ফুলের ভালো উৎপাদনের জন্য এর চাষের জমিকে খুব ভালোভাবে চাষ করতে হবে। গ্লাডিওলাস ফুল চাষের জন্য ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি গভীরতায় জমি চাষ করলে হবে। আর অবশ্যই জমির মাটি ঝুরঝুরে করতে হবে নিড়ানি বা লাঙ্গল দিয়ে।
তবে একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, গ্লাডিওলাস ফুলের মূল মাটির গভীরে বেশি গভীরে প্রবেশ করে না। আর তাই এর চাষের মাটিও খুব গভীরভাবে চাষ করার দরকার নেই।
আরো জানুন – বেলিফুল চাষ পদ্ধতি
গ্লাডিওলাস ফুল রোপণ বা চাষ পদ্ধতিঃ
সাধারণত গ্লাডিওলাস ফুল ৩ভাবে রোপন করা যায়। যথাঃ ১) কর্ম, ২) কর্মেল ও ৩) গ্লাডিওলাস ফুলের বীজের সাহয্যে। গ্লাডিওলাস ফুল রোপনের পূর্বে এর রোগমুক্ত বীজ/র্কম/কর্মেল নিতে হবে। তারপর তা মাটির ৩.৫ ইঞ্চি গভীরে রোপন করতে হবে। তবে উন্নত মানের ফুল পাওয়ার জন্য গ্লাডিওলাস ফুলকে এমনভাবে রোপন করতে হবে যেন সারি থেকে সারির দূরত্ব হয় ১২ ইঞ্চি এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব হয় ১০ ইঞ্চি।
তবে জমির অপচয় রোধ করার জন্য গ্লাডিওলাস ফুলের গাছ সমূহ ‘১০ ইঞ্চি x ৬ ইঞ্চি’ দূরত্বে রোপণ করা যেতে পারে।
গ্লাডিওলাস ফুল চাষে সার প্রয়োগ
গ্লাডিওলাস ফুল চাষের কেষেত্রে জমি তৈরীর সময় জমিতে শেষ চাষ দেওয়ার সময় প্রতি বর্গমিটার জমিতে কিছু জৈব ও রাসায়নিক সার ভালোভাবে জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে। তার পরিমাণ হলোঃ-
সারের নাম | পরিমাণ (প্রতি বর্গমিটারে) |
---|---|
গোবর সার | ৫-৬ কেজি |
টিএসপি সার | ৩০ গ্রাম |
এমওপি সার | ৩০ গ্রাম |
গ্লাডিওলাস ফুল চাষে বেশি ইউরিয়া সার দেওয়া উচিত নয়। কারণ, এর ফলে এই ফুলের পুষ্পদন্ড বেশি লম্বা ও দূর্বল হয়ে যায়। তাই এই ফুল রোপনের সময় প্রতি বর্গমিটারে ১০ গ্রাম ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবেেএবং ফুল গাছ রোপণের ২০-২৫ দিন পর গ্লাডিওলাস ফুলের গাছে পুষ্পদন্ড বের হওয়ার সময় আরো ১০ গ্রাম প্রতি বর্গমিটারে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
এছাড়াও জমির মাটিকে পোকামাকড় মুক্ত রাখতে জমি চাষের সময় ক্লোরডেন এবং মাটি বাহিত রোগ থেকে মুক্ত রাখতে মিথাইল ব্রোমাইড-ক্লোরোপিকরিনেএকর প্রতি ১৬২কেজি করে প্রয়োগ করে মাটি শোধন করতে হবে। এছাড়াও এই সময়ে ফুলের উৎপাদন ভালো করতে ও জমির মাটি ভালো রাখতে প্রতি একরে আরো কিছু সার প্রয়োগ করতে হবে। সেগুলো হলোঃ-
সারের নাম | পরিমাণ (একর প্রতি) |
---|---|
গোবর সার | ১০০০০কেজি |
টিএসপি সার | ২০ থেকে ২৫ কেজি |
এমওপি সার | ১৫ থেকে ২০ কেজি |
আরো পড়ুন – গাঁদা ফুলের চাষ পদ্ধতি
গ্লডিওলাস ফুল চাষের সময়ে পরিচর্যা
গ্লাডিওলাস ফুল চাষে নিয়মিত সেচ প্রদান
গ্লাডিওলাস ফুলের ভালো ফুল পাবার জন্য মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে রস থাকতে হবে। আর তাই কর্ম মাটিতে রোপন করার পর জমিতে হালকা সেচ দিতে হবে, যাতে কর্মগুলি মাটিতে ভালোবাবে লেগে যেতে পারে। আর এরপরে সময়গুলোতে আবহাওয়া বুঝে ১০ থেকে ১৫ দিন অন্তর অন্তর নিয়মিত সেচ দিতে হবে।
গ্লাডিওলাস ফুল চাষে নিয়মিত আগাছা দমন
গ্লাডিওলাস ফুলের ভালো উৎপাদন করতে নিয়মিতভাবে গভীর শিকড় যুক্ত আগাছা দমন করতে হবে।
গ্লাডিওলাস ফুল চাষে রোগ বালাই ও পোকা-মাকড় দমন পদ্ধতি
গ্লাডিৗলাস ফুল চাষের ক্ষেত্রে অনেক ক্ষতিকর পোকা আক্রমণ করে থাকে। এছাড়াও এই ফুলের গাছ বিভিন্ন রোগেও আক্রান্ত হয়ে থাকে। তাই নিকটবর্তী কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে গিয়ে যোগাযোগ করুন।
আরোও জানুন – গোলাপ ফুল চাষ পদ্ধতি
গ্লাডিওলাস ফুল কাটা বা উত্তোলন
সাধারণত গ্লাডিওলাস ফুলের বীজ বা কর্ম লাগানোর ৭৫ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে এর গাছে গ্লাডিওলাস ফুল ফোটে। এই গ্লাডিওলাস ফুল কাটার নিয়ম হলো যে দন্ডটিতে ফুল ও পাতা ধরে সেই দন্ডটি কাটা। আর এই গ্লাডিওলাস ফুল কাটার সাথে সাথে সেগুলোকে কিছুক্ষণ ছায়ায় রাখতে হবে।
গ্লাডিওলাস ফুলের চাষের ক্ষেত্রে একর প্রতি ১৩৫০০০ কর্ম বা বীজ জমিতে রোপন করলে সেখান থেকে ১০৫০০০-১২০০০০ পর্যন্ত গ্লাডিওলাস ফুলের স্টিক পাওয়া যায়।
কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য ও পরামর্শ, ফসলের চাষ পদ্ধতি, সার প্রয়োগ এবং ফসলের বিভিন্ন রোগ বালাই সম্পর্কে জানতে নিয়মিত ভিজিট করূন Krishakbd.com
FAQs
গ্লাডিওলাস ফুলের ইংরেজি নাম বা অপর নাম সোর্ড লিলি।
গ্লাডিওলাস ২ থেকে ৪ ফুট লম্বা হয়।