স্ট্রবেরি চাষ পদ্ধতি ও সার প্রয়োগ | ছাদে স্ট্রবেরি চাষ পদ্ধতি
স্ট্রবেরি অতি সুস্বাদু এবং লাভজনক একটি ফল। বাজারে স্ট্রবেরি ফলের ভালো চাহিদা ও দাম রয়েছে। তাই কৃষকরাও এই স্ট্রবেরি ফল চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। চলুন স্ট্রবেরি চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জেনে আসি।
স্ট্রবেরি চাষ বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে বেড়েছে। কারণ, স্ট্রবেরি ফল হলো একটি আকর্ষণীয় বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদযুক্ত এবং উচ্চ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন অর্থকারী ফসল। স্ট্রবেরির বৈজ্ঞানিক নাম হলো Fragaria ananassa. স্ট্রবেরি যদিও শীত প্রধান দেশের ফসল। তবে উষ্ণ মন্ডলীয় অঞ্চলের চাষ উপযোগী স্ট্রবেরি উদ্ভাবন হওয়া বাংলাদেশ সহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এই স্ট্রবেরি বানিজ্যিকভাবে চাষ করা হচ্ছে। আর ঘরের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে বাড়ির ছাদে বা আঙ্গিনায় টবে স্ট্রবেরি চাষ করা যায় এবং ভালো ফলন পাওয়া যায়। তাই আসুন স্ট্রবেরি চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানি।
আরোও পড়তে পারেন – সবচেয়ে লাভজনক ফল চাষ
স্ট্রবেরি চাষের আবহাওয়া নির্বাচন
স্ট্রবেরি ফল শীত প্রধান অঞ্চলের একটি ফসল। তবে বর্তমানে স্ট্রবেরির কিছু গ্রীষ্মমন্ডলীয় উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন হয়েছে। আর এসব স্ট্রবেরির জাত চাষের জন্য দিনের আবহাওয়ার তাপমাত্রা ২০-২৬ ডিগ্রি এবং রাতের আবহাওয়ার ১২-১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকা প্রয়োজন। স্ট্রবেরির ফল এবং ফুল আসার সময় শুষ্ক আবহাওয়া থাকা অত্যন্ত আবশ্যক। স্ট্রবেরির এই উচ্চফলনশীল জাতগুলো বাংলাদেশে রবি মৌসুম চাষের উপযোগী।
স্ট্রবেরি চাষের জমি ও মাটি নির্বাচন
স্ট্রবেরি চাষের জন্য বৃষ্টির পানি জমে না এমন উঁচু ও উর্বর জমি নির্বাচন করতে হবে। স্ট্রবেরি চাষের জন্য দো-আঁশ এবং বেলে-দোআঁশ মাটি উত্তম।
আরোও পড়ুন – আতা ফল চাষ পদ্ধতি ও রোগবালাই
স্ট্রবেরি চাষের জন্য স্ট্রবেরির জাত নির্বাচন
বর্তমানে স্ট্রবেরির কিছু উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন হয়েছে। আর সেসব স্ট্রবেরির জাত তুলনামূলক তাপ সহিষ্ণু। আর স্ট্রবেরির এই উচ্চফলনশীল জাত গুলোকে গ্রীষ্মায়িত জাত বলে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট স্ট্রবেরির যেসব উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে সেগুলো হলো: বারি স্ট্রবেরি-১, বারি স্ট্রবেরি-২ ও বারি স্ট্রবেরি-৩। স্ট্রবেরির এসব জাত গুলোর মধ্যে যেকোনো একটি নির্বাচন করতে হবে।
স্ট্রবেরি চাষের উপর্যুক্ত সময়
বাংলাদেশের আবহাওয়া অনুযায়ী স্ট্রবেরি চাষের উপর্যুক্ত সময় হলো আশ্বিন মাস বা মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য অক্টোবর মাস। তবে নভেম্বর মাস থেকে ডিসেম্বর মাসের মাধ্যে স্ট্রবেরির চারার রোপণ করা যাবে।
আরোও জানতে পারেন – ফলন বৃদ্ধির উপায়
স্ট্রবেরি চাষের আগে স্ট্রবেরির চারা বা বীজ সংগ্রহ
স্ট্রবেরি চাষেরে আগে পাশ্ববর্তী নার্সারি বা সার বিক্রয় কেন্দ্র থেকে বীজ সংগ্রহ করে বীজতলায় স্ট্রবেরির চারা তৈরী করতে হবে। অথবা নার্সারি থেকে স্ট্রবেরির চারা সংগ্রহ করতে হবে।
স্ট্রবেরি চাষের জমি তৈরি
স্ট্রবেরি চাষের পূর্বে স্ট্রবেরি চাষের জন্য নির্বাচিত জমিটি উত্তমরূপে কয়েকবার লাঙ্গল দিয়ে চাষ করে মই দিয়ে জমির মাটিগুলো ঝুরঝুরে করে নিয়ে স্ট্রবেরি চাষের জমি তৈরী করতে হবে। তারপর জমির আগাছা সমূহ পরিষ্কার করতে হবে।
আরোও জানুন – মরিচের ফলন বৃদ্ধির উপায়
ছাদে বা টবে স্ট্রবেরি চাষ পদ্ধতি
- প্রথমে ৮-১০ ইঞ্চির একটি টব সংগ্রহ করতে হবে।
- এরপর টবে জলের নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো রাখতে টবে কয়েকটি ছিদ্র করে তা নারকেলের ছোবড়া বা পলিথিন দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। এতে করে অল্প অল্প করে টব থেকে পারি নিষ্কাশিত হবে।
- তারপর সেই টবের ৩ ভাগের ১ ভাগ দো-আঁশ বা বেলে-দোআঁশ মাটি, ১ ভাগ বালি এবং ১ ভাগ পাতাপঁচা সার অথবা ভার্মি কম্পোস্ট সার নিয়ে ভালোভাবে মাটির মিশ্রণ তৈরি করতে হবে।
- এরপর মাটির সেই মিশ্রণটি টবে ভর্তি করতে হবে।
- এরপর টবে স্ট্রবেরির চারা সোজা করে রোপন করতে হবে।
- স্ট্রবেরির টবটি ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে এবং সকালে ও বিকেলে রোদে দিতে হবে।
- টবে স্ট্রবেরি গাছের নিয়মিত যত্ন করতে হবে।
- স্ট্রবেরি গাছের মরা পাতাগুলো কেটে দিতে হবে, স্ট্রবেরি গাছের গোড়ার মাটি মাঝে মাঝে খুঁচিয়ে আলগা করে দিতে হবে এবং গাছে নিয়মিত জল দিতে হবে।
স্ট্রবেরির চারা রোপন বা চাষ পদ্ধতি
- স্ট্রবেরি চাষের জমিতে স্ট্রবেরির চারা রোপণের ১৫-২০ দিন আগে প্রতি শতক জমিতে ৩০ গ্রাম হারে ব্লিচিং পাউডার জমিতে ছিটিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। এত মাটিবাহিত রোগ জীবাণু গুলো নষ্ট হয়ে যায়।
- তারপর ফাটিগেশন পদ্ধতিতে স্ট্রবেরি চাষের জন্য ১০-১৫ সেন্টিমিটার উঁঁচু এবং ১ মিটার প্রশস্ত একটি বেড তৈরি করতে হবে।
- স্ট্রবেরির বেডের সংখ্যা নির্ধারিত হবে জমির পরিমাপের উপর।
- ৩০-৫০ সেন্টিমিটার নালা তৈরী করতে হবে স্ট্রবেরি চাষের দুটি বেডের মাঝখানে।
- স্ট্রবেরির প্রতিটি বেডে স্ট্রবেরির চারা সোজা করে রোপন করতে হবে।
- আর স্ট্রবেরির একটি চারা থেকে আরেকটি চারা রোপনের দুরত্ব হবে ২০-৪০ সেন্টিমিটার।
স্ট্রবেরি চাষে সার প্রয়োগ পদ্ধতি ও সার প্রয়োগের প্রয়োগের পরিমাণ
মানসম্পন্ন স্ট্রবেরির উচ্চফলন পাওয়ার জন্য স্ট্রবেরি চাষের জমি তৈরী করার সময জমিতে শেষ চাষ দেওয়ার সময় জৈব সার ও বিভিন্ন রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে জমির মাটিতে ভালোভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
নিম্নে স্ট্রবেরি চাষের জন্য সার পয়োগের পরিমাণ দেওয়া হলোঃ-
সারের নাম | সারের পরিমাণ (হেক্টর প্রতি) |
পচা গোবর | ৩০ টন |
ইউরিয়া | ২৫০ কেজি |
টিএসপি | ১৭৫ কেজি |
এমওপি | ২০০ কেজি |
জিপসাম, | ১১৫ কেজি |
বরিক এসিড | ১২ কেজি |
জিংক সালফেট সার | ৮ কেজি |
ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে স্ট্রবেরি চাষ করার জন্য জমিতে স্ট্রবেরি চারা রোপনের ১৫ দিন পর থেকে প্রতি ১৫-২০ দিন পর পর ২০০ কেজি ইউরিয়া সার এবং ১৫০ কেজি এমওপি সার সেচের পানির সাথে স্ট্রবেরি চাষের জমিতে প্রয়োগ করলে স্ট্রবেরির ভালো ফলন পাওয়া যায়।
আরোও জানুন – তরমুজ চাষে অধিক লাভ
স্ট্রবেরির জমিতে পানির সেচ ও নিষ্কাশন
- স্ট্রবেরি চাষের জমিতে রসের অভাব দেখা দিলে মাটির অবস্থা বুঝে প্রয়োজনমতো পানির সেচ দিতে হবে।
- স্ট্রবেরি গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। তাই স্ট্রবেরি চাষের জমিতে বৃষ্টি ও সেচের পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা করতে হবে।
- যদি ফার্টিগেশন পদ্ধতিতে স্ট্রবেরি চাষ করা হয় তাহলে জমিতে সরাসরি সেচ না দিয়ে সেচের পানিেএকটি নলের মাধ্যমে সরাসরি স্ট্রবেরি গাছের গোড়ায় ফোঁটা ফোঁটা করে প্রয়োগ করতে হবে।
স্ট্রবেরি চাষে জমিতে মাল্চ প্রয়োগ এবং পরিচর্যা
- জমিতে স্ট্রবেরি চারা রোপণ করার ২০-২৫ দিন পর স্ট্রবেরি চাষের বেড খড় বা কাল পলিথিন অর্থাৎ মাল্চ দিয়ে ভালো করে ঢেকে দিতে হবে। আর খড়ে যাতে উঁইপোকা আক্রমণ না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- আর স্ট্রবেরি চাষের জমিতে ৩ মিলিলিটার ডার্সবান ২০ ইসি ও ২ গ্রাম ব্যাভিস্টিন ডিএফ প্রতি লিটার পানির সাথে ভালোভাবে মিশিয়েে ঐ দ্রবণ স্ট্রবেরি চাষের খড়ের মাল্চ এ প্রয়োগ করলে উঁইপোকা আর আক্রমণ করবে না এবং স্ট্রবেরি ফল সুরক্ষিত থাকে।।
- স্ট্রবেরি চাষের জমি সর্বদা আগাছামুক্ত ও পরিষ্কার রাখতে হবে।
- স্ট্রবেরি গাছের গোড়া থেকে প্রতিনিয়ত রানার বের হয়। আর স্ট্রবেরির এই রানারগুলো ১০-১৫ দিন অন্তর অন্তর কাটতে হবে।
স্ট্রবেরি গাছের রোগ-বালাই ব্যবস্থাপণা
স্ট্রবেরি গাছের পাতায় দাগ পড়া রোগ ও প্রতিকার
অনেক সময় স্ট্রবেরি গাছের পাতায় বাদামি রং এর দাগ দেখা যায়। এই দাগ পড়া রোগের আক্রমণ দেখা দিলে স্ট্রবেরির ফলন এবং ফলের গুণগত মান কমে যায়।
স্ট্রবেরি গাছের পাতায় এই দাগ পড়া রোগ দেখা দিলে সিকিউর নামক ছত্রাকনাশক ২ গ্রাম হারে প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন অন্তর অন্তর স্ট্রবেরি গাছে ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
স্ট্রবেরি ফল পচা রোগ ও প্রতিকার
স্ট্রবেরি গাছে ফল পচা রোগের আক্রমণ দেখা দিলে স্ট্রবেরি ফলের গায়ে জলে ভেজা বাদামি বা কালো রঙের দাগ দেখা যায়। আর স্ট্রবেরির এই দাগ দ্রুত ফলে ছড়িয়ে পড়ে এবং স্ট্রবেরি ফল খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
তাই এই স্ট্রবেরি ফল পঁচা রোগ প্রতিরোধ কারর জন্য স্ট্রবেরি ফল পরিপক্ব হওয়ার আগে প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম হারে নোইন ৫০ ডব্লিওপি অথবা ব্যাভিস্টিন ডিএফ নামক ছত্রাকনাশক ভালোভাবে মিশিয়ে ৮-১০ দিন অন্তর অন্তর স্ট্রবেরি গাছে ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
স্ট্রবেরি ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
পৌষ মাস থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত সময়টি হলো স্ট্রবেরি ফল উত্তোলনের উপর্যুক্ত সময়। স্ট্রবেরি ফল পেকে লাল রং ধারণ করলে স্ট্রবেরি ফর ফল সংগ্রহ করতে হবে। স্ট্রবেরি ফলের সংরক্ষণের সময় খুবই অল্প বলে জমি থেকে স্ট্রবেরি ফল সংগ্রহের পর পরই সেই ফলগুলো টিস্যু পেপার দিয়ে মুড়িয়ে প্লাস্টিকের ঝুড়ি বা ট্রেতে সংরক্ষণ করতে হবে এবং কেয়াল রাখতে হবে যাতে স্ট্রবেরি ফলগুলো গাদাগাদি অবস্থায় না থাকে। আর স্ট্রবেরি ফল সংগ্রহের পর যত দ্রুত সম্ভব বাজারজাত করতে হবে।
স্ট্রবেরির ফলন
হেক্টরপ্রতি ৩৫-৪০ হাজার স্ট্রবেরি চারা রোপণ করে গাছ প্রতি গড়ে ২৫০-৩০০ গ্রামের ১০-১২ টন স্ট্রবেরি পাওয়া যায়। ফাটিগেশন পদ্ধতিতে স্ট্রবেরি চাষ করলে হেক্টরপ্রতি স্ট্রবেরির ফলন পাওয়া যায় প্রায় ১৫-২০ টন।
আরোও জানুন – করমচা চাষ পদ্ধতি
কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য ও পরামর্শ, ফসলের চাষ পদ্ধতি, সার প্রয়োগ এবং ফসলের বিভিন্ন রোগ বালাই সম্পর্কে জানতে নিয়মিত ভিজিট করূন Krishakbd.com
FAQs
স্ট্রবেরি গাছের চারার দাম হলো ৩০-৩৫ টাকা।
১ প্যাকেট স্ট্রবেরি বীজের দাম ১৫০-২৫০ টাকা।
নিয়মিত স্ট্রবেরি খেলে স্ট্রবেরিতে থাকা ফ্যাট বার্নিং হরমোন আমাদের ওজন কমাতে সাহায্য করে। স্ট্রবেরির উপকারিতা হলো স্ট্রবেরি আমাদের ক্ষুধা মেটাতে এবং পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও স্ট্রবেরি খাওয়ার উপকারিতা হলো স্ট্রবেরিতে থাকা পটাশিয়াম আমাদের শরীরের রক্ত চলাচল সচল রাখে এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে।
১ কেজি বা ১০০০ গ্রাম স্ট্রবেরিতে ৩২০ ক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়।
মার্চ মাসে স্ট্রবেরির ফলন পাওয়া যায়।
১ কেজি স্ট্রবেরির দাম হলো ৩০০-৪০০ টাক।