কচু চাষ পদ্ধতি
মুখী কচু একটি উচ্চফলনশীল ও দীর্ঘমেয়াদি ফসল। এটিকে সাধারণত ছড়া কচু, গুড়া কচু, বন্নি কচু, ইত্যাদি নামে পরিচিত।। এটি খুবই সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাদ্য।

কচু সবার কাছে খুবই পরিচিত একটি সবজি। কচুর মূল থেকে শুরু করে কচুর কান্ড, পাতা, ফুল, লতি সবকিছুই পাওয়ার উপযোগি। অর্থাৎ এর কোনো অংশই ফেলা হয় না।
বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গাতে কচু জন্মায়। অনেক প্রজাতির কচু আছে, যা যত্নের সঙ্গে চাষ করা হয়ে থাকে আমাদের দেশে।
কচু ডাঙা ও পানি, দুই স্থানেই বেশ সহজে জন্মাতে পারে। তবে কচু মাটিতে বেশি জন্মায়। কিছু কচু আছে, যেগুলো বনজঙ্গলে জন্মে থাকে, এগুলো বুনো কচু নামে পরিচিত। এ ধরনের কচু মানুষের খাওয়ার উপযোগী নয়।
মানুষের পাওয়ার উপযোগী জাতের মধ্যে মুখিকচু বা ছড়াকচু,, দুধকচু, মানকচু, পানিকচু, বিষকচু, পঞ্চমুখিকচু ও ওলকচু উল্লেখযোগ্য।
কচুর পুষ্টিগুণঃ কচুতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন আছে, যা মানবদেহের জন্য খুবই উপকারি। এই সবজির পুষ্টিগুণ অবাক করার মতো।
কচুর মূল উপাদান হলো (Fe), যা মোবিনের মাত্রা ঠিক রাখে ফলে আমাদের শরীরে অক্সিজেনের সরবরাহ ঠিক রাখে।
প্রতি ১০০ গ্রাম কচুশাকে ৩৯ গ্রাম প্রোটিন, ৬ দশমিক ৮ গ্রাম শর্করা, ২০ গ্রাম চনি, ২২৭ মিলি গ্রাম ক্যালসিয়াম, ১০ মিলিগ্রাম আয়রন ৩৫৬ মিলিগ্রাম পাদ্যশক্তি থাকে। যা আমাদের শরীরের জন্য খুবই উপকারী।
মুখী কচুর কিছু তথ্য
মুখী কচু আমাদের দেশে সাধারণত ছড়া কচু, গুড়া কচু, কুড়ি কচু, দুলি কচু, বন্নি কচু, ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। এটি খুবই সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাদ্য। এতে প্রচুর পরিমাণ শ্বেতসার, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ফসফরাস এবং ভিটামিন এ ও সি আছে। মুখীকচুর স্টার্চের হজম যোগ্যতা বেশী বিধায় এর স্টার্চ শিশুদের খাদ্য হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
মুখীকচু ক্ষারজাতীয় খাদ্য বিধায় অম্ল শুলেও এটি উপকারী। এটি খরিপ মৌসুমে সবজির অভাব পূরণ করে। তবে আশানুরূপ ফলন পওেত হলে এই ফসল উৎপাদনের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি অনুসরণ করতে হবে।
মুখী কচু চাষ উপযোগী মাটি ও জলবায়ু : বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া মুখীকচু চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। সারাদিন রোদ থাকে এমন স্থানে মুখীকচু জন্মায়।
দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি মুখীকচু চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। তবে জমিতে প্রচুর পরিমাণ জৈব পদার্থ থাকা উচিত। এ ফসলের জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু খুবই প্রয়োজন।
মুখী কচুর জাত : বাংলাদেশে মুখীকচুর অসংখ্য স্থানীয়জাত আছে। তবে আশানুরুপ ফলন পেতে উচ্চফলনশীল জাতের চাষ করা উত্তম। আর সে উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান “বিলাসী” নামে মুখীকচুর একটি উচ্চ ফলনশীলজাত উদ্ভাবন করেছে।
“বিলাসী” জাত এর মুখীগুলো খুব মসৃণ ও ডিম্বাকৃতির। এই জাতে পাতার মড়ক রোগে সহজে আক্রান্ত হয় না। এই জাতে পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয়।
এটি সিদ্ধ করলে মুখী সমানভাবে সিদ্ধ হয়। এর মুখী নরম ও সুস্বাদু এবং ক্যালসিয়াম আক্সালেটের পরিমান কম থাকায় খাওয়ার পর গলার ভেতরে চুলকায় না। অতিসম্প্রতি বারি মুখীকচু-২ নামে আরও একটি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবিত হয়েছে।
মুখী কচুর জীবনকাল : মুখী কচুর জীবনকাল ১৮০-২০০ দিন হয়ে থাকে।
মুখী কচু চাষে জমি তৈরীঃ মাটির জোঁ থাকা অবস্থায় জমির প্রকারভেদে ৪-৫ টি লম্বা ও আড়াআড়ি চাষ করতে হবে এবং মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে দিতে হবে।
মুখী কচুর বীজের পরিমাণ : মুখী কচুর বীজ সাধারণত মুখীর ছড়া বীজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি বীজের ওজন ১৫-২০ গ্রাম হওয়া বাঞ্চনীয়। প্রতি শতক জমিতে রোপনের জন্য উল্লিখিত ওজনের ২-২.৫ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।
মুখী কচুর বীজ বপনের সময় : পানি সেচের ব্যবস্থা অনুযায়ী ফাল্গুন বা ফেব্রুয়ারি মাস বীজ বপনের সবচেয়ে ভাল সময়। কিন্তু যদি পানি সেচের সে সুযোগ না থাকে তাহলে বৃষ্টিপাতের জন্য অপেক্ষা করতে হবে এবং প্রথম বৃষ্টিপাত হওয়ার সাথে সাথে বীজ লাগাতে হবে।
তবে বৈশাখ বা এপ্রিলের পরে বীজ লাগালে ফলন কমে যাবে।
মুখী কচুর বীজ লাগানোর দূরত্ব : সাধারণত বীজ লাগানোর দূরত্ব নির্ভর করে মাটির গুনাগুনের উপর। সাধারণত ৭৫-২৫ সেমি দূরত্বে বীজ বপন করা উচিৎ। যদি মাটির উর্বরতা কম হয় তবে ৬০×২৫ সেমি দূরত্বে বীজ বপন করতে হয়।
মুখী কচু চাষে ডাবল সারি পদ্ধতি : এ পদ্ধতিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২.৫ ফুট এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২.০ ফুট বেশি উপযোগী বলে প্রমাণিত হয়েছে। আড়াই ফুট দূর করে লম্বালম্বি দাগ টানতে হবে এবং এই দাগের উভয় পাশে ৪ ইঞ্চি দূরে ২ ফুট পর পর বীজ লাগাতে হবে।
এতে দুই সারির মধ্যে দূরত্ব ২২ ইঞ্চি এবং এক সারির দুই লাইনের মধ্যে দুরত্ব হয় ৮ ইঞ্চি। এই পদ্ধতিতে বীজ লাগালে ফলন প্রায় ৪০-৫০% বেড়ে যায়।
মুখী কচু চাষে সার প্রয়োগ : আশানুরুপ ফলন পেতে হলে বিলাসীর জন্য নিম্নলিখিত হারে সার প্রয়োগ করতে হবে।
উপাদান | শতক প্রতি পরিমাণ |
গোবর | ৬১ কেজি |
ইউরিয়া | ৬০০গ্রাম |
টিএসপি | ৫০০ গ্রাম |
এমওপি | ৭০০গ্রাম |
জমি তৈরীর সময় ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সারগুলো পুরো অংশ জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
চারা গজাবার ৪০-৪৫দিন পর ১ম কিস্তি বা ৩০০ গ্রাম পরিমাণ ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে এবং ৯০-১০০ দিন পর ২য় কিস্তিতে বা বাকি ৩০০গ্রাম ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে।
মুখী কচুর চাষকালীন পরিচর্যা : ইউরিয়া সার প্রয়োগের পরপরই জমির সারি বরাবর আইল তুলে দিতে হবে। যেসব এলাকায় বৃষ্টিপাত বেশী সেখানে গাছের গোড়া খড়কুটো দিয়ে ঢেকে রাখলে উপকার পাওয়া যায়।
তাছাড়া চারা গজানো থেকে শুরু করে ফসল উঠানোর প্রায় এক মাস পূর্ব পর্যন্ত জমি অবশ্যই পরিষ্কার রাখতে হবে।
মুখী কচুর চাষের জমির আগাছা দমন : মুখী কচু ৬-৯ মাসের একটি র্ঘমেয়াদী ফসল। গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালের উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় জমিতে প্রচুর আগাছা জন্মে। পুরো উৎপাদন মৌসুমে ৪-৬ বার আগাছা দমন করতে হবে।
প্রতিবার উপরি সার প্রয়োগের আগে অবশ্যই আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। চারা লাগানোর দুই মাস পর হতে প্রতি মাসে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
মুখী কচুর চাষের জমির পানি সেচ ও নিষ্কাশন : মুখী কচু খরা মৌসুমে লাগানো হলে বীজ অঙ্কুরোদগমের জন্য তো বটেই তবে প্রাথমিক বৃদ্ধি পর্যায়ে মাটির প্রকারভেদে ১০-২০ দিন পর পর সেচ দিতে হবে।
বর্ষাকালে সেচ দেয়ার দরকার পড়ে না তবে অভিনব পদ্ধতিতে পানি নিষ্কাশন করতে হবে। মনে রাখতে হবে মুখী কচুর উচ্চ ফলনের জন্য প্রয়োজনীয় সেচ ও নিষ্কাশন যথাসময়ে করতে হবে।
মুখী কচুর গাছের গোড়ায় মাটি তোলা : চারা রোপনের ৪০-৪৫ এবং ৯০-১০০ দিন পর দুই সারির মাঝের মাটি কুপিয়ে ঝুরঝুরে করে গাছের গোড়ায় তুলে দিতে হবে।
মুখী কচুর গাছের পোকামাকড়ের আক্রমণ ও তার প্রতিকার : পোকা মাকড়ের মধ্যে ক্ষুদ্র মাকড়সার (মাইট) ও জাব পোকার আক্রমণ দেখা যায়। প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি নিউরন। এভোজিন/টক/ এডমারার বা যে কোন মাইট ভ্রমনকারী ঔষধ মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পরপর জমিতে প্রয়োগ করে এ মাকড় দমন করা যায়।
কোন কোন সময় প্রভোনিয়া ক্যাটারপিলার দ্বারা আক্রান্ত হতে দেখা যায়। এমতাবস্থায় হাতে পিষে অথবা যে কোন সংস্পর্শ ঔষধ মিশিয়ে গাছে প্রয়োগ করলে এই পোকা সহজেই দমন করা যায়।
মুখী কচুর গাছের রোগ বালাই ও তার প্রতিকার : কচুতে পাতা পোড়া রোগ ও কান্ড পচাঁ রোগের আক্রমণ দেখা যায়। পাতা পোড়া রোগ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে ডায়থেন এম-৪৫ অথবা রিডোমিল গোল্ড ২ গ্রাম/লি হারে পানিতে মিশিয়ে ১ মাস অন্তর অন্তর ৩ বারগাছে প্রয়োগ করতে হবে।
কান্ড পঁচা রোগ হলে ১-২ গ্রাম রিডোমিল প্রতি লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে গাছেপ্রয়োগ করতে হবে। ঔষধের সাথে কিছু সাবানের গুড়া মিশালে বশি ভাল হয়।
মুখী কচুর ফসল সংগ্রহ : মুখীকচুর গাছগুলো যখন হলদে হয়ে শুকিয়ে যেতে থাকে তখনি এই কচু উঠানোর সময়। পরিপক্কতা লাভের পরও প্রয়োজন বোধে ফসল কয়েক মাস ক্ষেতে রেখে দেয়া হয়। এতে প্রায় ৬-৭ মাস সময় লাগে। অবশ্য ব্যবসায়ের প্রয়োজনে ২-১ মাস আগে মুখীকচু উঠিয়ে বাজারজাত করা যেতে পারে।
মুখী কচুর ফলন : বিলাসী প্রতিটি গাছে ১টি করে গুড়ি কন্দ, ৫-১০ টি গুড়ি কন্দিকা এবং অনেক মুখী উৎপন্ন হয়। মুখীই এর প্রধান ভক্ষণযোগ্য অংশ। প্রতি শতকে ফলন প্রায় ১২০-১৪০ কেজি পর্যন্ত পাওয়া যায়।
সংরক্ষণ পরবর্তী মৌসুমে বীজ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনমত মুখী না উঠিয়ে মাটিতে রেখে দিলে বীজ ভাল থাকে। বর্তমানে যে পরিমাণ জমিতে মুখী কচুর চাষ করা হচ্ছে তার মাত্র অর্ধেক পরিমান জমিতে মুখী কচুর এই বিলাসী জাতের চাষ করে মোট উৎপাদন দ্বিগুন করা সম্ভব।
মুখী কচুর সংরক্ষণ পদ্ধতি : ভালোভাবে সতর্কতার সাথে মুখী কচুর গুড়ি তুলতে হবে। কাটা, পচা, ক্ষতযুক্ত, ছোট-মাঝারি-বড় আকার দেখে আলাদা করে রাখতে হবে।
ঠান্ডা ও ছায়াময় এবং বাতাস চলাচলের সুবিধাযুক্ত স্থানে স্তুপ করে বা মেঝেতে ছড়িয়ে মুখীকচু শুকানো যায়। ছায়ায় শুকানোর পর কচু নাড়াচড়া করলে গুড়ির গায়ের মাটিসহ অন্যানা ময়লা পড়ে গিয়ে গুড়ি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
এরপর ঘরের ছায়াযুক্ত স্থানে মাচা বা কাঠের উপর রেখে শুকনো ঠান্ডা পরিষ্কার বালি দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। এভাবে মুখীকচু ৪/৬ মাস পর্যন্ত অনায়াসে সংরক্ষণ করা যায়।
মুখী কচু একটি উচ্চফলনশীল ও দীর্ঘমেয়াদি ফসল। এ ফসল চাষে অধিক লাভবান হওয়া যায়। তাই আসুন মুখীিকচুর চাষ করি।
কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য ও পরামর্শ, ফসলের চাষ পদ্ধতি, সার প্রয়োগ এবং ফসলের বিভিন্ন রোগ বালাই সম্পর্কে জানতে নিয়মিত ভিজিট করূন Krishakbd.com