কচুরিপানা দিয়ে কম্পোষ্ট সার তৈরীর পদ্ধতি
বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র প্রাকৃতিক জলাশয়ে প্রচুর পরিমান কচুরিপানা জন্মে থাকে।পরিকল্পিতভাবে কচুরিপানা পচিয়ে উন্নতমানের জৈব সার তৈরি করা যায়।
মাটির গঠন ও গুণাগুণ ঠিক রাখতে জৈব সারের কোন বিকল্প নেই। জৈব সার ব্যবহারে মাটির উৎপাদিকা শক্তি যেমন ঠিক থাকে তেমনি রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীলতাও হ্রাস পায়।
আবাদি ফসলে জৈব সারের তুলনায় রাসায়নিক সারের ব্যবহার বেশি হয়। অথচ রাসায়নিক সার ফলন বাড়ালেও ধীরে ধীরে মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে দেয়।
এছাড়া মানবদেহের পাশাপাশি প্রাণিবৈচিত্র ও পরিবেশেরও ক্ষতি করে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য জৈবসারের ব্যবহার বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই।
জৈব সার হিসাবে সাধারণত গোবর, খৈল, হাস-মুরগীর বিষ্ঠা, খামারজাত সার, সবুজ সার, কেচো কম্পোস্ট, কুইক কম্পোস্ট ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।
বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র প্রাকৃতিক জলাশয়ে প্রচুর পরিমান কচুরিপানা জন্মে থাকে । বিভিন্ন জলযান চলাচলে এবং মাছ চাষে কচুরিপানা বেশ অসুবিধা সৃষ্টি করলেও পরিকল্পিতভাবে কচুরিপানা পচিয়ে উন্নতমানের জৈব সার তৈরি করা যায়।
সাধারণত দুটি পদ্ধতিতে কচুরিপানা কম্পোস্ট তৈরী করা যায়। যথা –
- স্তুপ পদ্ধতি
- গর্ত পদ্ধতি
কচুরিপানা কম্পোস্ট তৈরীতে স্তুপ পদ্ধতি
বসতবাড়ির আশেপাশে, পুকুর বা ডোবার ধারে কিংবা ক্ষেতের ধারে যেখানে বন্যার কিংবা বৃষ্টির পানি দাড়াবার কোন সম্ভাবনা নেই এমন জায়গাকে কম্পোস্ট সার তৈরীর স্থান হিসাবে নির্বাচন করতে হবে।
স্তুপের উপরে চালা দিতে হবে অথবা গাছের নিচে স্থান নির্বাচন করতে হবে যাতে রোদ বৃষ্টি থেকে রক্ষা পায় ।
স্তুপের আকার – সাধারণত ৩ মিটার দৈর্ঘ্য, ১.২৫ মিটার প্রস্থ এবং ১.২৫ মিটার উঁচু গাদা তৈরী করা হয়। তবে সুবিধা অনুযায়ী এই মাপ কম বেশি হতে পারে।
প্রথমে জলাশয় থেকে সংগৃহীত কচুরিপানা কিছুটা টুকরা টুকরা করে ২/৩ দিন রোদে হালকা শুকিয়ে নিতে হবে। এরপর কচুরিপানা ফেলে ১৫ সে. মিটার উচু স্তুপ তৈরী করা হয়।
কচুরিপানার পাশাপাশি গোয়াল ঘরের গোবর, খড়, গো-চনা, কাঠের গুড়া, ছাই, লতাপাতা ইত্যাদি উচ্ছিষ্ট অংশ কচুরিপানার সাথে মেশানো যায়।
এবার সাজানো স্তরের ওপর আনুমানিক ২০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ২০০ গ্রাম টিএসপি সার ছিটিয়ে দেয়ার পর স্তরের উপরিভাগে ৩ থেকে ৫ সে. মিটার পুরু করে জলাশয়ের তলদেশের কাদামাটি ও গোবরের প্রলেপ দিয়ে দিতে হয়।
এতে পচন ক্রিয়ার গতি যেমন বাড়বে তেমনি কম্পোস্ট সারের মানও বাড়বে। তাছাড়া এতে স্তর আঁটসাট হয় এবং পুষ্টি উপাদান গ্যাস হয়ে উড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে না।
প্রথম স্তরের উপর একইভাবে কয়েকটি স্তর তৈরি করতে হবে। এভাবে সমগ্র স্তুপের উচ্চতা ১.২৫ মিটার হয়ে গেলে সমগ্র স্তুপকে ১৫ সে. মিটার পুরু কাদা মাটির প্রলেপ দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
গাদা তৈরী শেষ হলে কড়া রোদে গাদা যেন শুকিয়ে না যায় আবার বৃষ্টিতে ধুয়ে না যায় সেজন্য গাদার ওপর ছাউনির ব্যবস্থা করতে হবে। খড়, খেজুর পাতা, নারিকেল পাতা কিংবা তালপাতা দিয়ে কম খরচে এই চালা তৈরী করা যায়।
কম্পোস্ট স্তূপ পরীক্ষা – কম্পোস্ট স্তুপ তৈরী করার এক সপ্তাহ পর একটি শক্ত কাঠি কম্পোস্ট গাদার মাঝখানে ঢুকিয়ে যদি অতিরিক্ত ভেজা মনে হয় তবে গাদার উপরিভাগে বিভিন্ন অংশে কাঠি দিয়ে ছিদ্র করে স্তুপের ভিতর বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
২/৩ দিন পর গর্ত বা ছিদ্রগুলো মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। আর গাদা অতিরিক্ত শুকনা মনে হলে ছিদ্রের মাধ্যমে পানি অথবা গো-চনা ঢেলে দিতে হবে।
জৈব পদার্থে পানির পরিমাণ ৬০-৭০ ভাগ থাকা বাঞ্ছনীয়। কম্পোস্ট তাড়াতাড়ি পচে সার হওয়ার জন্য স্তর সাজানোর ১ মাস পর প্রথমবার এবং ২ মাস পর দ্বিতীয় বার গাদার স্তরগুলো কোদাল দিয়ে ওলট পালট করে দিতে হবে।
এ সময় কম পচা আবর্জনাগুলো গাদার মাঝখানে রাখতে হবে। কম্পোস্ট সার ঠিকমতো পচলে ধূসর বা কালো বর্ণ ধারণ করে, কোন পচা গন্ধ থাকেনা এবং আংগুলে চাপ দিলে গুঁড়া হয়ে যায়।
সাধারণত ২/৩ মাসের মধ্যে কচুরিপানা পচে জমিতে ব্যবহার উপযোগী কম্পোস্ট সার তৈরি হয়ে যায়।
কচুরিপানা কম্পোস্ট তৈরীতে গর্ত পদ্ধতি
পানি দাড়ায় না কিংবা কম বৃষ্টিপাত এলাকা কিংবা শুকনো মৌসুমে গর্ত পদ্ধতিতে কম্পোস্ট তৈরী করা যায়
গাছের ছায়ার নিচে বাড়ির পেছন দিকে অথবা গোশালার পাশেই কম্পোস্ট গর্ত তৈরী করা সব দিক থেকে সুবিধাজনক ।
সাধারণত ১.২৫ মিটার প্রস্থ ১ মিটার গভীর ও ২.৫ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি গর্ভ তৈরী করা হয়। গর্ভের তলায় বালু অথবা কাঁকর দিয়ে দুরমুজ করে দিতে হবে যাতে জলীয় পদার্থ শোষণ করে নিতে পারে।
প্রয়োজনে ধানের খড় বিছিয়ে বা গোবর কাদার সাথে মিশিয়ে গর্তের তলা এবং চারপাশে লেপে দেয়া যেতে পারে।
গর্তের ওপর দিকে ভূমি থেকে খানিকটা উঁচু করে আইল তৈরী করে দিতে হবে যাতে বাইরে থেকে কোন পানি গড়িয়ে গর্তে পড়তে না পারে।
তাছাড়া ইট, বালু, সিমেন্ট দিয়ে পাকা গর্ত তৈরি করে তার ভিতর কম্পোস্ট সার তৈরি করা যায়। এবার গাদা পদ্ধতির মতো করে গর্তে কচুরিপানা স্তরে স্তরে সাজিয়ে কম্পোস্ট তৈরী করতে হবে।
গর্ত ভরাট না হওয়া পর্যন্ত স্তরের পর স্তর সাজিয়ে যেতে হবে। স্তর সাজানো শেষ হলে স্তরের ওপর কাদা মাটির প্রলেপ দিয়ে দিতে হবে।
মাটির প্রলেপ দেয়ার আগে স্তর ভালভাবে ঠেসে দিতে হবে। সাধারণত ১০ টন কচুরিপানা পচিয়ে গড়ে ৩ টন কম্পোস্ট সার পাওয়া যেতে পারে।
কম্পোস্ট ব্যবহারের নিয়ম
ধান, পাট, আলু, গম ও শাকসবজিসহ সকল ফসল চাষে কম্পোস্ট সার ব্যবহার করা যায়। বেলে দোআঁশ, বরেন্দ্র, লালমাটি এবং মধুপুরগড় এলাকার জন্য কাম্পোস্ট বেশ কার্যকর।
সাধারণত জমির উর্বরতা ভেদে প্রতি হেক্টর জমির জন্য ৫ থেকে ৮ টন কম্পোস্ট সার ব্যবহার করা হয়। কম্পোস্ট জমিতে ছিটিয়ে দেয়ার পরে চাষ দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়।
জৈব সার দেওয়ার ৭ থেকে ১০ দিন পর জমিতে ফসল উৎপাদনের কাজ শুরু করতে হবে।
কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য ও পরামর্শ, ফসলের চাষ পদ্ধতি, সার প্রয়োগ এবং ফসলের বিভিন্ন রোগ বালাই সম্পর্কে জানতে নিয়মিত ভিজিট করূন Krishakbd.com