দ্বিগুণ ফলন ও দ্বিগুণ লাভ করতে জানুন আলু চাষের সঠিক নিয়ম

আলু একটি নিত্য প্রয়োজনীয় সবজি। আলু চাষে অল্প সময়ে বেশি লাভবান হওয়া যায়। তাই আলু চাষের সঠিকপদ্ধতি সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।

আলু চাষ পদ্ধতি

আলু একটি সুস্বাদু ও নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য। বাংলাদেশে ভাতের চাহিদার পরই আলুর অবস্থান। দামের দিক থেকে সহজলভ্য বিধায় এর চাহিদাও ব্যপক। আলু নিতান্তই শীতপ্রধান অঞ্চলের ফসল। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলেও আলু ভালো জন্মে। তবে গাছ বৃদ্ধির প্রথম দিকে অধিক তাপ ও শেষ দিকে বা কন্দ ধরা কালীন সময়ে কম তাপ থাকা বাঞ্ছনীয়। কার্তিক মাসের শুরুতেই আলু চাষের উপযুক্ত সময়। বর্তমানে আলুর দাম ভালো থাকায় কুষকরা আলু চাষ করে আর্থিকভাবে দ্বিগুণ লাভ করছে। আসুন জেনে নিই আলু চাষের সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে।

আরোও জানতে পারেন – মিষ্টি আলু চাষ পদ্ধতি

আলু চাষ পদ্ধতি

আলু চাষের জমি তৈরি

আলুর জন্য জমি তৈরি ও বীজ বপনের উপযুক্ত সময় কার্তিক মাস। বেলে দো-আঁশ মাটি আলু চাষের জন্য বেশ উপযোগী। চারা রোপনের পূর্বে জমি ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে ঝুরঝুরে করে নিতে হয়। 

আলুর জাত ও বীজ নির্বাচন

ভালো ফলনের জন্য বীজ আলু হিসেবে ডায়মন্ড, মুল্টা, কার্ডিনাল, প্যাট্রেনিজ, হীরা, মরিন, অরিগো, আইলশা, ক্লিওপেট্রা, গ্রানোলা, বিনেলা, কুফরিসুন্দরী উল্লেখযোগ্য। প্রতি হেক্টর জমি আবাদ করতে ১৫০০ থেকে ২০০০ কেজি বীজ আলু দরকার।

আলুর বীজ বপনের পূর্বে করণীয়

বীজ প্রত্যয়িত হলে বপনের আগে আর কোনো রকম ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। অন্যথায় বীজ শোধন করে নেওয়া ভালো। আলুর বীজ শোধনের জন্য কার্বন ডাইজিম গোত্রীয়, ফার্মালডিহাইড (Formaldehyde) অথবা ইয়েলো অক্সাইড অব মার্কারি (Yellow oxide of mercury) ব্যবহার করা যায়।

উক্ত তরল গুলোতে আলুর বীজকে কিছুক্ষণ চুবিয়ে উঠিয়ে নিলেই বীজ শোধন হয়ে যায়। তবে কাটা বীজ ব্যবহার করতে গেলে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন-

  • বীজ কাটার সময় ধারালো ছুড়ি দিয়ে লম্বালম্বি কাটতে হবে।
  • বীজের কাটা দিকটায় পরিষ্কার ঠাণ্ডা ছাই লাগিয়ে দিতে হবে। এই সমস্ত সাবধানতা অবলম্বন করলে বীজ পচে নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা কম থাকবে।

সারিতে দুই পদ্ধতিতে আলুর বীজ বপন করা যায়

পদ্ধতি – ১

প্রতি সারি বরাবর ৫-৭ সেন্টিমিটার মাটি সরিয়ে নিয়ে নালা প্রস্তুত করা হয়, তারপর সেই নালাতে নির্দিষ্ট দূরত্বে আলুর বীজ বপন করে মাটি দ্বারা বীজ ঢেকে দেওয়া হয়।

পদ্ধতি – ২

  • সারির মাটি না খুড়ে অর্থাৎ নালা না করে সারির দাগ বরাবর আলুর বীজ নির্দিষ্ট ব্যবধানে বপন করার পর দুই সারির মধ্যবর্তী জায়গা হতে মাটি টেনে উঁচু করে বীজ ঢেকে দেওয়া হয়৷
  • শেষোক্ত পদ্ধতিটিই বিজ্ঞানসম্মত, কেননা এতে জমির রস অধিক দিন বজায় থাকে এবং সারির মাটি আলগা থাকে বলে আলুর কন্দ বৃদ্ধিতে কোনো বাধার সৃষ্টি হয় না।
  • অন্য দিকে প্রথমোক্ত পদ্ধতিতে নালার মাটি চাপ খাওয়া থাকে বলে কন্দের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে কন্দ অর্থাৎ আলুর আকার ছোট থেকে যায়।

আলুর বীজ হার

বপনের জন্য প্রতি হেক্টরে সাধারণত ১৫০০-২০০০ কেজি বীজ লাগে। তবে বীজ আকারে বড় হলে কিছু বেশি এবং ছোট হলে কিছু কম লাগে।

আলুর বীজ বপন দূরত্ব

রোপণের দূরত্ব ৬০-২৫ সেন্টিমিটার (আস্ত আলু) এবং ৪৫-১৫ সেন্টিমিটার (কাটা আলু)৷

আলু চাষে সার ব্যবস্থাপনা

সারের নামশতাংশ প্রতিহেক্টর প্রতি
ইউরিয়া৮০০ গ্রাম – ১ কেজি২২০ – ২৫০ কেজি
টিএসপি  ৪০০ – ৬০০ গ্রাম১২০ – ১৫০ কেজি
এমওপি৮০০ গ্রাম – ১ কেজি২২০ – ২৫০ কেজি
জিপসাম ৩৫০ – ৫০০ গ্রাম১০০ – ১২০ কেজি
জিঙ্ক সালফেট৫০ – ৭০ গ্রাম৮ – ১০ কেজি
গোবর সার৩০ – ৪০ টন৮ – ১০ টন

আলু চাষে সেচ ব্যবস্থাপনা

আলুর অধিকাংশ মুল মাটির কম গভীরতায় থাকায় সময়মত সেচ প্রয়োগ না করলে মাটিতে পানি ঘাটতির দরুণ ফলন কমে যায়। আলুর তিনটি সংবেদনশীল বৃদ্ধি পর্যায় রয়েছে যে সময় সেচ প্রয়োগ একান্ত অপরিহার্য। 

  • প্রথম সেচ : বীজ আলু বপনের ২০-২৫ দিনের মধ্যে (স্টোলন বের হওয়া পর্যায়ে)
  • দ্বিতীয় সেচ : বীজ আলু বপনের ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে (গুটি বের হওয়া পর্যায়ে)
  • তৃতীয় সেচ : বীজ আলু বপনের ৬০-৬৫ দিনের মধ্যে (গুটি বৃদ্ধি পর্যায়ে)

সেচ এমনভাবে প্রয়োগ করতে হয় যেন গাছের গোড়ার মাটি ভালভাবে ভিজে। গভীর বা অগভীর নলকূপ বা ভূ-উপরিস্থ পানি হতে পলিথিন হুস পাইপ বা ফারো (নালা) পদ্ধতিতে সেচ প্রয়োগ করাই উত্তম। 

আলুর পরিচর্যা

  • আলু উৎপাদনে আগাছা পরিষ্কার, সেচ, সারের উপরি প্রয়োগ, মাটি আলগাকরণ বা কেলিতে মাটি তুলে দেওয়া, বালাই দমন, মালচিং করা আবশ্যক। সময়মতো সবগুলো কাজ করতে পারলে খরচ কমে আসে, ফলন বেশি হয়।
  • চারা গাছের উচ্চতা ১০-১৫ সেন্টিমিটার হলে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। দুই সারির মাঝে সার দিয়ে কোদালের সাহায্যে মাটি কুপিয়ে গাছের গোড়ায় তুলে দিতে হবে।
  • ১০-১২ দিন পরপর এভাবে গাছের গোড়ায় মাটি তুলে না দিলে ভালো হয়।

আলুর রোগ দমন/বালাই ব্যাবস্থাপনা

  1. আলু ফসলে নাবি ধসা রোগ দেখা দিতে পারে। মড়ক রোগ দমনে ২ গ্রাম ডায়থেন এম ৪৫ অথবা সিকিউর অথবা ইন্ডোফিল প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ৭ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।
  2. মড়ক লাগা জমিতে সেচ দেওয়া বন্ধ রাখতে হবে। তাছাড়া আলু ফসলে মালচিং, সেচ প্রয়োগ, আগাছা দমনের কাজগুলোও করতে হবে।
  3. গাছের বয়স ৯০ দিন হলে মাটির সমান করে গাছ কেটে ১০ দিন পর আলু তুলে ফেলতে হবে। আলু তোলার পর ভালো করে শুকিয়ে বাছাই করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

আলু চাষের ক্ষেত্রে অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা

আলু গাছের গোড়ায় মাটি দেওয়া

আলু লাগানোর ৩০-৩৫ দিন পর গোড়ায় মাটি দেওয়া প্রয়োজন। জমিতে আলুর গাছ যখন ৫-৬ ইঞ্চি অর্থাৎ ১২-১৫ সেন্টিমিটার হয় তখন দুই সারির মাঝখানের মাটি হালকাভাবে কুপিয়ে নরম ঝুরঝুরা করে নিতে হয়। এই সময় জমির আগাছা নিধনের কাজও হয়ে যায়৷ নরম ঝুরঝুরা মাটি কোদালি দ্বারা টেনে সারিতে গাছের দুই দিকে দেওয়া হয়।

আলু বড় করার উপায়

বর্তমানে বাংলাদেশে আলু বড় করার জন্য বিভিন্ন কোম্পানির বেশকিছু জৈবিক কীটনাশক বা হরমোন গোত্রীয় ঔষধ রয়েছে। যেমন জিএ ৩, নাইট্রোবেনজিম (ফ্লোরা), পিজিআর, জিব্রেলিক এসিড ইত্যাদি।

আলুর বানিজ্যিক নাম

আলুর বাণিজ্যিক নাম হলো গ্রীন লিপ, ফ্লোরা, মারিয়া পিজিআর, পাওয়ার, টরাস, প্রটোজিম ইত্যাদি।

আলু চাষে কীটনাশক ব্যবহার বিধি

আলুর চারা রোপনের ৩০-৩৫ দিন পর মাত্রানুযায়ী প্রথম স্প্রে এবং প্রথম স্প্রে করার ২০-২৫ দিন পর দ্বিতীয় স্প্রে করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে স্প্রে করার সময় যেন ভালোভাবে গাছ ভিজিয়ে স্প্রে করা যায়। এটি যে কোন কীটনাশক এর সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করা সম্ভব।

আলুর বাজার দাম

বাংলাদেশ আলুর বাজার দাম সবসময় একরকম থাকে না। মৌসুম ভেদে এর দাম তারতম্য হয়। যখন আলুর ফলন হয়, ফলন বাজারে আসার পরে প্রতি মণ ৪০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। পরবর্তী পর্যায়ে এটি আস্তে আস্তে বৃদ্ধি হতে থাকে। অনেক সময় প্রতি মণ ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত ওঠে।রআবার অনেক সময় এর দাম কমেও যায়। এটি সম্পূর্ণ নির্ভর করে বাজারের চাহিদার উপর। 

আলু সংগ্রহ

আলুর সারিতে কোদালের সাহয্যে বা লাঙল চালিয়ে আলু মাটি থেকে তোলা হয়৷ তবে আলু তোলার সময় সতর্ক থাকতে হবে যাতে আলু কেটে বা থেতলিয়ে না যায়, কেননা আলু থেতলিয়ে গেলে সংরক্ষণ করার সময় পচে যায়৷

FAQs

আলু চাষের জমি কিভাবে তৈরি করা হয়?

আলু চাষের জন্য দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটির জমি নির্বাচন করে সে জমিতে আলুর চাষ করার আগে জমিটি ৫-৬ বার চাষিএবং বার কয়েক মই দিয়ে জমির মাটি ঝুরাঝুরা করে জমি পাইট করতে হয়। 

টবে আলু চাষ পদ্ধতি কি?

টবে আলু চাষ পদ্ধতি হলো টবের দুই তৃতীয়াংশ পরিমাণ মাটি-সারের মিশ্রণ টবে নিয়ে উপরের অংশ সমতল করে সেখানে আলুর বীজ ৫ বা ৭ ইঞ্চি পরপর মাটিতে পুতে দিতে হবে। আলুর বীজ লাগানো হলে সে বীজের উপর ৪-৫ ইঞ্চি করে মাটির মিশ্রণ দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।

দেশি আলু চাষ পদ্ধতি কি?

দেশি আলু চাষ পদ্ধতি হলো কার্তিক মাসে দেশী আলু চাষের জমি তৈরী করে সেখানে সারি থেকে সারির দুরত্ব ৫০ সেমি এবং গাছ থেকে গাছের দুরত্ব ২০ সেমি রেখে মাটির ৪-৫ সেমি গভীরে আলুর বীজ বপন করতে হবে। 

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *