দেশী মুরগী পালনের সঠিক পদ্ধতি
বর্তমানে দেশী মুরগী পালন করে কৃষকরা অনেক লাভবান হচ্ছেন। এটি দেশের অর্থনীতিতেও ভালো অবদান রাখছে। তাই জানুন দেশী মুরগী পালন পদ্ধতি সম্পর্কে।
দেশী মুরগী পালন করে বর্তমানে অনেক কৃষক এবং কৃষাণি সাবলম্বী হচ্ছেন। ফলে দেশী মুরগী পালন বর্তমানে আমাদের দেশের জাতীয় অর্থনীতি ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কারণ, দেশী মুরগী পালন করতে তেমন জায়গারও প্রয়োজন হয় না আর তেমন বিনিয়োগেরও প্রয়োজন পড়ে না।
তাই দেশী মুরগী পালন বেকার যুব সমাজে ভূমিহীন কৃষক এবং গরীব গ্রামীন মহিলাদের আত্ম- কর্মসংস্থানের একটি উল্লেখযোগ্য উপায় হয়ে দাড়িয়েছে। আর আদিকাল থেকে গ্রাম বাংলার মহিলাদের বাড়তি আয়ের উৎস হিসাবে দেশী মুরগি পালন করা একটি অন্যতম পদ্ধতি। কারণ, দেশী মুরগী পালনের মাধ্যমে তারা প্রতিদিনের ডিম বিক্রি করেও নিত্যদিনের চাহিদা পূরণ করতে পারছে। এছাড়াও বাজারে বর্তমানে দেশী মুরগীর দাম কেজি প্রতি ৩০০-৪০০ টাকা। তাই খুব সহজে দেশী মুরগী পালন করে অর্থ উপার্জন করা যায়।
তবে দেশী মুরগীর উৎপাদন ক্ষমতা বিদেশী মুরগীর চেয়ে কম। কিন্তু বিদেশি মুরগীর তুলনায় দেশী মুরগী পালনে বায় অনেক কম। তবে বিদেশী মুরগীর তুলনায় দেশী মুরগী পালনে আয় বেশি। তাই আসুন জেনে নিই দেশী মুরগী পালন পদ্ধতি সম্পর্কে।
দেশি মুরগীর বৈশিষ্ট্য বা দেশী মুরগী চেনার উপায়
দেশী মুরগী পালনের আগে দেশী মুরগী চিনতে হবে এবং দেশী মুরগীর বৈশিষ্ঠ্য সম্পর্কে জানতে হবে। দেশি মুরগি র বৈশিষ্ঠ্য হলো দেশী মুরগীর মাংস এবং ডিম অন্যান্য বিদেশী মুরগীর জাতের তুলনায় বেশি স্বাদযুক্ত ও মজাদার। দেশি মুরগির ডিম অন্য মুরগী ডিম থেকে ছোট। তবুও দেশী মুরগীর ডিম ও মাংশের দাম বেশি। দেশি মুরগির রোগ বালাইও কম হয়ে থাকে তাই দেশী মুরগী পালনে তেমন কোন ঝুঁকি ও প্ররিশ্রম নেই। দেশি মুরগীর রোগের বিষয়ে ধারণা থাকলে দেশী মুরগির রোগ বালাই দমন করা যায়।
দেশি মুরগী পালন পদ্ধতি
দেশী মুরগি সাধারণত দুই ভাবে পালন করা যায়। যথা:
- সনাতন পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালন
- আধুনিক পদ্ধতি দেশি মুরগি পালন
আসুন জেনে নিই কোন পদ্ধতিতে দেশী মুরগী পালন করা সুবিধাজনক হবে।
ক) সনাতন পদ্ধতিতে দেশী মুরগী পালন পদ্ধতি
আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেশি মুরগী সনাতন পদ্ধতিতে পালন করা হয়। সনাতন পদ্ধতিতে দেশী মুরগী পালন বলতে ছেড়ে দিয়ে মুরগি পালন কে বোঝায়। এই সনাতন পদ্ধতির প্রধান ত্রুটি হল স্বল্প পুঁজি এবং স্বপ্ন আয়। আসুন জেনে নিই কিভাবে সনাতন পদ্ধতিতে দেশী মুরগী পালন করবঃ-
সনাতন পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালনের সমস্যা
আমাদের দেশে বেশিরভাগ এই ঐতিহ্যবাহী সনাতন পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালন করে থাকলেও এই প্রক্রিয়াতে রয়েছে দেশি মুরগি পালনের নানা অসুবিধা। এভাবে দেশি মুরগি পালন করলে লাভ কম হয়, মুরগির উৎপাদন চক্রে বেশি সময় লাগে, কম ডিম পাড়ে, কম বাচ্চা হয়, বেশি রোগ দেখা দেয়, মুরগি ও বাচ্চা মারা যায় ইত্যাদি।
সনাতন পদ্ধতিতে দেশি মুরগীর উৎপাদন চক্র
সনাতন পদ্ধতিতে দেশি মুরগীর উৎপাদন চক্র শেষ হতে প্রায় ১৪০-১৭০ দিন সময় লেগে যায়। তাই চলুন দেশী মুরগির উৎপাদন চক্র সম্পর্কে জেনে আসি।
দেশি মুরগীর উৎপাদন চক্রকে সাধারণত ৪ ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন:
- ডিম পাড়া- ১৮ থেকে ২৪ দিন
- ডিম কুচি বা তা- ২১ দিন
- বাচ্চা পালন- ৯০-১০০ দিন
- বিশ্রাম- ১০-১৫ দিন
১) সনাতন পদ্ধতি দেশি মুরগীর ঘর তৈরি
দেশি মুরগির চাষের জন্য খোলামেলা মুরগীর ঘর তৈরী করতে হবে। দেশি মুরগির ঘরের পরিমাপ হবে লম্বায় ১.৫ মিটার বা ৫ ফুট, চওড়ায় ১১.২ মিটার বা ৪ ফুট এবং উচ্চতায় ১ মিটার বা ৩.৫ ফুট। দেশী মুরগীর ঘরের বেড়া বাঁশের বেড়া বা কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি করতে হবে। ঐ বেড়াতে আলো-বাতাস চলাচলের জন্য ছিদ্র থাকতে হবে। দেশি মুরগির ঘরের চাল তৈরি করতে হবে খড়, টিন বা বাঁশের দরজার সাথে পলিথিন দিয়ে। এরকম ঘরে ১০-১৫টি দেশি মোরগ-মুরগি পালন করা যাবে।
২) দেশি মুরগীকে খাদ্য খাওয়ানো
বাড়িতে দেশী মুরগী পালনে দোকান থেকে তেমন কোনো খাবার ক্রয় করতে হয় না। কারণ, দেশি মুরগী বাড়ির প্রতিদিনের বাড়তি বা বাসী খাদ্য (যেমন: ফেলে দেওয়া ভাত, তরকারি, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সম, ধান, পোকামাকড়, শাক সবজির ফেলে দেওয়া অংশ, ঘাস, লাতা পাতা, কাঁকর, পাথর কুচি ইত্যাদি) কুড়িয়ে খায়। এতে দেশি মুরগির বিভিন্ন পুষ্টি পূরণ হয় সুস্থ্য থাকে।
৩) সনাতন পদ্ধতিতে দেশি মুরগির পরিচর্যা
ছেড়ে পালন বা সনাতন পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পরিচর্যার জন্য সময় বা লোকজনের তেমন দরকার পড়ে না। তেমন কোন খরচ ছাড়াই ভাল একটা মুনাফা আশা করা যায় সনাতান পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালনে। কিন্তু কিছু নিয়ম মেন চলতে হয় দেশী মুরগী পালনে। নিম্নে বর্ণণা করা হলো-
- সকালে দেশি মুরগির ঘর খুলে কিছু খাবার দিতে হবে।
- সন্ধ্যায় দেশি মুরগি ঘরে ওঠার আগে আবার কিছু খাবার দিতে হবে।
- মুরগী ঘরে উঠলে দরজা বন্ধ করে দিতে হবে।
- মুরগির পায়খানা ঘরের মেঝেতে যেন লেপ্টে না যায় সেজন্য মেঝেতে ধানের তুষ বা কাঠের গুঁড়া ১ ইঞ্চি পুরু করে বিছিয়ে দিতে হবে ।
- পায়খানা বা লিটার শক্ত জমাট বেঁধে গেলে বারবার তা উলট-পালট করে দিতে হবে।
- কিছুদিন পর পর মুরগীর পায়খানা বা লিটার পরিষ্কার করতে হবে।
এ পদ্ধতিতে দেশি মোরগ-মুরগি পালন করা গেলে তেমন কোন খরচ ছাড়াই ভাল একটা মুনাফা পাওয়া যাবে।
খ) আবদ্ধ অবস্থায় বা আধুনিক পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালন
আমাদের দেশে খুব কম ব্যক্তিই আধুনিক পদ্ধতি বা আবদ্ধ অবস্থায় দেশি মুরগি পালন করে থাকে। এই আধুনিক পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালন করতে বেশি পুঁজি লাগে কিন্তু লাভ তুলনামুলক কম হয়। আর এই আধুনিক ভাবে দেশি মুরগি পালন করা হয় না কারন মুরগীর কম বৃদ্ধি হয় এবং মুরগী ছোট আকৃতির হয়। আবদ্ধ অবস্থায় পালন করা আনেক অর্থের বায় হয় এবং এই পদ্ধতিতে দেশি মুরগি ১ বছরে ৩০-৪০ টি ডিম দিয়ে থাকে। যা একেবারেই লাভজনক নয়।
দেশী মুরগীর রোগ-বালাই দমন ব্যবস্থা
দেশি মুরগির রাণিক্ষেত রোগ
দেশী মুরগী পালনে প্রধান প্রতিবন্ধকতা বা দেশি মুরগির প্রধান রোগ হলো রাণীক্ষেত রোগ। এই রাণীক্ষেত রোগের প্রচলিত নাম হলো চুনা মল ত্যাগ। এই রোগে মুরগি হা করে ঠোঁট তুলে শ্বাস নেয়। ঝিমুনী ও ধীরে ধীরে পক্ষাঘাত হয়। বড় মুরগির নাকে শব্দ হয়। ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত এই রোগটি মুরগির শ্বসনতন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্রের উপর বিশেষ আক্রমণ করে।
এছাড়াও আরো বিভিন্ন রোগে মুরগী সংক্রমিত হয়। সেগুলো হলো: গামবোরা রোগ, পুলোরাম রোগ, বসন্ত রোগ, ফাউল কলেরা রোগ, হিট স্ট্রোক রোগ, আমাশয় রোগ ইত্যাদি।
দেশী মুরগীর রোগের প্রতিকার
- প্রতিষেধক টিকা প্রয়োগ করলে দেশি মুরগীর রোগের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবে।
- এছাড়াও রোগাক্রান্ত মোরগ-মুরগীর ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য উচচক্ষমতা সম্পন্ন এন্টিবায়োটিক দিতে হবে।
- আক্রান্ত মুরগীকে অবশ্যই অন্যান্য দেশী মুরগীর সংস্পর্শ থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।
- মরে যাওয়া মুরগীকে ২-৩ হাত মাটির নীচে পুঁতে ফেলতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে দেশি মুরগির গুরুত্ব অপরিসীম। তুলনামূলক স্বল্প বিনিয়োগ এবং অল্প ভূমিতে দেশী মুরগী পালন বাস্তবায়নযোগ্য বিধায় জাতীয় অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
FAQs
গ্যাবল টাইপ ঘর বলতে দোচালা ঘরকে বোঝায়। খোলা অবস্থায় বা অর্ধ-আবদ্ধ অবস্থায় হাঁস-মুরগি পালনের জন্য এ ধরনের ঘর খুবই উপযোগী। তবে এই ঘর তৈরিতে খরচ বেশি হয়। এ ধরনের ঘরের ছাদ ঢালু থাকে। সাধারণত যেসব অঞ্চলে বেশি বৃষ্টিপাত হয়, সেখানকার জন্য গ্যাবল টাইপ ঘর খুবই উপযোগী।
মুরগির শক্তির চাহিদা মেটাতে এবং ওজন বাড়াতে প্রচুর কার্বোহাইড্রেটের প্রয়োজন হয়। আর উচ্চ প্রোটিন জাতীয় খাদ্য দেশি মুরগিকে দ্রুত বৃদ্ধি করতে সাহায্য করতে পারে। তাই আমিষ বা উদ্ভিদ জাতীয় প্রোটিন মুরগিকে সরবরাহ করলে মুরগির বাচ্চা দ্রুত বড় হবে।
মুরগি সনাতন পদ্ধতি বা মুক্ত অবস্থায় অথবা আবদ্ধ অবস্থায় পালন করতে হয়।
মুরগি পালন পদ্ধতি ৪ প্রকার। যথাঃ- ১) সনাতন পদ্ধতি, ২) আধুনিক পদ্ধতি, ৩) লিটার পদ্ধতি ও ৪) মাঁচা পদ্ধতি।
ব্রয়লার মুরগি কার্নিশ এবং প্লাইমাউথ রক জাতের হয়।