আধুনিক পদ্ধতিতে ধনিয়া চাষ করে সারা বছরই আয় করুন
ধনিয়া একটি মশলা জাতীয় খাবার হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা প্রচুর। তাই কৃষকরা ধনিয়া চাষে অদিক লাভবান হচ্ছে। আসুন জেনে নিই ধনিয়া চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে।
বর্তমান বাজারে ধনিয়ার চাহিদা প্রচুর। কারণ, ধনিয়া একটি মশলা জাতীয় খাবার বলে রান্নায় এই ধনিয়ার ব্যবহার করা হয় প্রচুর। তাই কৃষকরা এই ধনিয়া চাষ করে আর্থিকভাবে প্রচুর লাভবান হোন। ধনিয়া এমন একটি খাবার যা রান্নার স্বাদ দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। ধনিয়াকে রান্নায়ও ব্যবহার করা যায় কিংবা কাঁচা অবস্থায় সালাদের সাথে ব্যবহার করে খাওয়া যায়। এছাড়া ধনিয়ার বীজও বিভিন্ন মুখরোচক খাবারে সঙ্গে মিশিয়ে যুক্ত করে খাওয়াা যায়। তাই আসুন জেনে নিই কিভাবে আধুনিক পদ্ধতিতে ধনিয়া চাষ করা যায় সে সম্পর্কে।
ধনিয়া চাষের উপযুক্ত সময়
প্রায় সারা বছরই ধনিয়া চাষ করা যায়। তবে ধনিয়ার জাত ভেদে এপ্রিল-জুন মাসের তীব্র গরমে ধনিয়া চাষ করা যায় না। তাই এপ্রিল থেকে জুন মাস সময় বাদে বাকি সময় ধনিয়া চাষের উপর্যুক্ত সময়। তবে ধনিয়া চাষ বা ধনিয়ার বীজ রোপনের উপর্যুক্ত সময় হলো মধ্য ভাদ্র মাস থেকে মধ্য আশ্বিন মাস পর্যন্ত। অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসই হলো ধনিয়াা চাষের উপযোগী সময়। যদিও সারা বছর ধনিয়া চাষ করা যায। তবে এই সময় ধনিয়া চাষ করলে ধনিয়ার উৎপাদন ভালো হয়।
ধনিয়া চাষের জন্য মাটি ও জমি নির্বাচন
প্রায় সব ধরনের মাটিতে ধনিয়া চাষ করা গেলেও ধনিয়া চাষের জন্য বেলে দো-আঁশ এবং এটেল দো-আঁশ মাটি খুবই উপযোগী। প্রায় সব ধরণের জমি ধনিয়া চাষের উপযোগী হলেও ধনিয়া চাষের জমিতে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা থাকতে হবে।
ধনিয়ার জাত নির্বাচন
বর্তমানে কৃষক ভাইদের কথা মাথায় রেখে ধনিয়ার কিছু উচ্চফলনশীল ও উন্নত জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এসব ধনিয়ার জাতের উৎপাদন সাধারণ ধনিয়ার জাতের তুলনায় বেশি হয় এবং এসব ধনিয়ার জাত সারা বছরই চাষ করা যায়। ধনিয়ার এই উন্নত জাতের মধ্যে অন্যতম হলোঃ- বারি ধনিয়া ১, এলবি-৬০, এলবি-৬৫, সুগন্ধা ইত্যাদি।
ধনিয়া বীজ সংগ্রহ
আধনিক পদ্ধতিতে ধনিয়া বীজ বপনের জন্য বিঘা প্রতি জমিতে ধনিয়া চাষের জন্য ১.৩-১.৬ কেজি ধনিয়া বীজ প্রয়োজন হয়। আর ছিটিয়ে ধনিয়ার বীজ বোনার জন্য দ্বিগুন ধনিয়ার বীজের প্রয়োজন হয়। এছাড়া ধনিয়া বীজ জমিতে ছিটিয়ে বপন করলে হেক্টরপ্রতি ৮ কেজি ধনিয়ার বীজের প্রয়োজন হয়।
আর মিশ্র ফসল হিসেবে সার পদ্ধতিতে ধনিয়ার বীজ বপন করলে সেক্ষেত্রে ৪-৫ কেজি ধনিয়ার বীজ হলে হয়। আর এই ধনিয়ার বীজ সঙগ্রহ করতে হয় নিকটবর্তী কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট অথবা বাজারে সারের দোকান থেকে।
ধনিয়া চাষ পদ্ধতি
ধনিয়া চাষের জন্য প্রথমে জমি নির্বাচন করতে হবে। তারপর মাটির প্রকার ভেদে ধনিয়া চাষের পূর্বে জমিতে মই দিয়ে ৪-৬ টি চাষ দিয়ে জমি তৈরি করে নিতে হবে। এরপর নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করুন:
- জমিতে ধনিয়ার বীজ বপনের আগে ধনিয়ার বীজগুলো পানিতে আগের দিনে বা ২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে।
- তারপর ধনিয়ার বীজ গুলো ছিটিয়ে দিতে হবে।
- আর সারি সারি করে মাঝখানে সামান্য জায়গা রেখে ধনিয়া চাষ করলে ভালো হয়।
- এছাড়া চাইলে অন্যান্য ফসলের সাথে ধনিয়ার চাষ করা যায়। সেক্ষেত্রে অন্যান্য ফসল যেখানে উৎপাদিত হচ্ছে তার পাশে খালি জায়গা গুলোতে ধনিয়ার বীজ ছিটিয়ে দিতে হবে। এতে ধনিয়া বীজের পরিমাণ তুলনামুলক অর্ধেক কমে যাবে।
ধনিয়া চাষে সার প্রয়োগের পরিমাণ
ধনিয়ার ভালো ফলন পেতে হলে মাটির ধরণ অনুযায়ী জমিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে ধনিয়া সহ যেকোনো ফসল চাষে জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈব সার ব্যবহার করা উচিৎ। এতে জমির মাটির গুণাগুণ ও আশেপাশের পরিবেশ উভয়ই ভালো থাকবে। নিম্নে ধনিয়া চাষে সারের পরিমাণ দেও্রয়া হলোঃ-
সারের নাম | সারের পরিমাণ (হেক্টরপ্রতি) |
---|---|
গোবর সার | ৮-১০ টন |
ইউরিয়া সার | ২৮০-৩১০ কেজি |
টিএসপি সার | ১১০-১৩০ কেজি |
এমওপি সার | ৯০-১১০ কেজি |
জিংক সালফেট | ১২-১৫ কেজি |
জিপসাম | ৬০-৭৫ কেজি |
আরও পড়ুন:
ধনিয়া চাষে সার প্রয়োগ পদ্ধতি
- ধনিয়া চাষের জন্য জমি তৈরির সময় অর্ধেক বা ৪-৫ টন গোবর সার, সব টিএসপি সার এবং অর্ধেক বা ৪৫-৫৫ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
- এরপর বাকি অর্ধেক বা ৪-৫ টন গোবর সার জমিতে ধনিয়ার বীজ রোপনের ১ সপ্তাহ আগে মাদায় দিয়ে মিশিয়ে রাখতে হবে।
- এরপর ধনিয়ার বীজ রোপন করে জমিতে সেচ দিতে হবে।
- ইউরিয়া সার সহ বাকি অর্ধেক ৪৫-৫৫ কেজি এমওপি ২ কিস্তিতে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
- জমিতে ধনিয়ার বীজ বপনের ৮-১০ দিন পর যেসব সার বাকি রয়েছে তার অর্ধেক ১ম কিস্তিতে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে এবং ধনিয়ার বীজ বপনের ৩০-৫০ দিন পর বাকি সব সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
ধনিয়া চাষে সেচ প্রদান
- ধনিয়া চাষের জন্য মাটির অবস্থা বুঝে ৩/৪ দিন পর পর হালকা পানির সেচ দিন।
- আর সেচের পানি যাওয়ার জন্য ধনিয়ার জমিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ধনিয়ার জমিতে প্রতিবার সেচের পর জমিতে ’জো’আসা মাত্র মাটির চটা ভেঙ্গে দিতে হবে।
- আর গ্রীষ্মকালে ধনিয়ার বীজ ফেলার পর বেডের উপর হালকা করে খড় বিছিয়ে দিতে হবে। যাতে সেচ বা বৃষ্টির পানির ছিটিয়ে ধনিয়ার চাষের জমির মাটি লাগতে না পারে ।
ধনিয়া চাষে পরিচর্যা
- জমিতে ধনিয়ার চারা গজানোর ১০-১৫ দিন পর প্রত্যেক সারিতে ৫ সেন্টিমিটার পর পর একটি চারা রেখে বাকি চারাগুলো তুলে ফেলতে হবে।
- আর ধনিয়ার বীজ ফসলের ক্ষেত্রে প্রতি ১০ সেন্টিমিটার পর পর জমিতে একটি চারা রাখতে হয়।
- নিড়ানি দিয়ে ধনিয়ার জমির আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং মাঝের মধ্যে ধনিয়ার জমির মাটি ঝুরঝুরে করে দিতে হবে।
- ধনিয়া চাষের জমিতে যাতে সেচ বা বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি জমে না থাকে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
ধনিয়ার রোগ-বালাই ও পোকা-মাকড় ব্যবস্থাপনা
ধনিয়ার বিছাপোকা দমন
ধনিয়া চাসের ক্ষেত্রে ধনিয়া গাছে বিছাপোকা আক্রমণ করে। এই বিছাপোকা দমন করার জন্য প্রতি ১০ লিটার পানিতে এমামেক্টীন বেনজোয়েট জাতীয় কীটনাশক (যেমনঃ- প্রোক্লেইম ১০ গ্রাম) অথবা সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (যেমন-রিপকর্ড অথবা সিমবুশ ২০ মিলিলিটার / ৪ মুখ) মিশিয়ে প্রতি ৫ শতক জমিতে ১০ দিন পর পর ২ বার স্প্রে করতে হবে। তবে ধনিয়ার ঔষধ স্প্রে করার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
ধনিয়ার শোষক পোকা/হেপার/শ্যামাপোকা, জাবপোকা এবং সাদামাছি দমন
ধনিয়ার শোষক পোকা/হেপার/শ্যামাপোকা, জাবপোকা এবং সাদামাছি দমনের জন্য ১০ লিটার পানিতে ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক (যেমনঃ- এডমায়ার অথবা টিডো ৭-১০ মিলিলিটার / ২মুখ) অথবা কারবারাইল জাতীয় কীটনাশক (যেমনঃ- সেভিন ২০ গ্রাম) মিশিয়ে প্রতি ৫ শতক জমিতে ১০ দিন পরপর ২/৩ বার স্প্রে করতে হবে। এছাড়া ধনিয়া পাতার নিচের দিকে যেখানে পোকা থাকে সেখানে ঔসুধ স্প্রে করতে হবে।
ধনিয়ার কাটুই পোকা দমন
ধনিয়ার কাটুই পোকা দমনের জন্য কারটাপ জাতীয় কীটনাশক ১০ লিটার পানিতে (যেমনঃ- কেয়ার ৫০ এসপি অথবা সানটাপ ৫০ এসপি ২০ মিলি / ৪ মূখ ) অথবা ল্যামডা-সাইহ্যালোথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (যেমনঃ-ক্যারাটে ২.৫ ইসি অথবা ফাইটার প্লাস ২.৫ ইসি ১৫ মিলি / ৩ মূখ ) প্রতি ৫ শতক জমিতে স্প্রে করতে হবে ১০ দিন পরপর ২/৩ বার।
ধনিয়ার শিকড় পচা রোগ ও প্রতিকার
- ধনিয়ার মূল বা শিকড় পচা রোগ থেকে ধনিয়া গাছকে রক্ষা করতে নিমের কেক ৬০ গ্রাম প্রতি একর জমিতে ব্যবহার করতে হবে।
- এছাড়া ধনিয়ার বীজ জমিতে বোনার আগে ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি ৪ গ্রাম ১কেজি বীজের সাথে মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। তারপর জমিতে ধনিয়ার বীজ বপন করতে হবে।
- এছাড়াও ধনিয়ার শিকড় পচা রোগের প্রদিকার করার জন্যে Carbendazim ৫ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে অথবা কপার অক্সি ক্লোরাইড ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ধনিয়ার জমির মাটিতে ছিটিয়ে দিতে হবে।
ধনিয়ার ফলন
জাতভেদে শতক প্রতি ধনিয়ার ৬.৮-৮.০ কেজি ফলন পাওয়া যায়।
FAQs
১ কেজি ধনিয়া বীজের দাম ২০০-২৫০ টাকা।
১ কেজি ধনিয়া গুঁড়ার মুল্য ৬০০ টাকা।
কয়েকটি উচ্চফলনশীল ধনিয়ার জাত হলোঃ- বারি ধনিয়া ১, এলবি-৬০, এলবি-৬৫ এবং সুগন্ধা।
ধনিয়া চাষের সময় হলো ধনিয়ার জাতভেদে এপ্রিল-জুন মাসের তীব্র গরম বাদ দিয়ে প্রায় সারা বছরই।